Nearby Attraction

NEAR BY

ডুয়ার্স নিয়ে প্রাথমিক কিছু ধ্যান ধারণা।

‘ডুয়ার্স’ শব্দের অর্থ ‘দুয়ার’ পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং জেলার তিস্তা নদীর পূব প্রান্ত, জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলার অধিকাংশ আর কোচবিহার জেলার পশ্চিমের কিছু অংশ নিয়ে ডুয়ার্সের ব্যাপ্তি।
উত্তরে রিশপ, লাভা, লোলেগাঁও, কোলাখাম, চারখোল থেকে শুরু করে পশ্চিমে সেবক, দক্ষিণে গাজোলডোবা, আর পূবে জয়ন্তী, চিলাপাতা অবধি ডুয়ার্সের বিস্তার। মাইন্টেন, হিল, রিভার, ফলস, ফরেস্ট এসব নিয়েই ডুয়ার্স।
তবে ভৌগোলিক দিক থেকে ডুয়ার্স কে দু ভাগে বলা যেতে পারে। হিল ডুয়ার্স আর গ্রীন ডুয়ার্স। কালিম্পং জেলার অন্তর্ভুক্ত ডুয়ার্সের ভ্রমণ কেন্দ্র গুলোকে হিল ডুয়ার্সের অংশ বলা যেতে পারে। সমতলের জঙ্গল আর চা বাগান ঘেরা সবুজ অংশকে গ্রীন ডুয়ার্স বলে।

চালসাকে বলা হয় ডুয়ার্সের গেট ওয়ে বা প্রবেশ পথ। যতই লাটাগুড়ি নিয়ে পর্যটন মহলে মাতামাতি হোক না কেন, চালসা হল সেন্টার। যাকে কেন্দ্র করে আপনারা ডে ভিজিটেই বহু জায়গা ঘুরে নিতে পারেন। তাতে সময় আর অর্থ দুটোই বাঁচবে। চালসা থেকে লাটাগুড়ি ২০ কিমি। তাই লাটাগুড়ি তে থেকে আপনি যেখানেই যান না কেন, আপনাকে চালসা হয়েই যেতে হবে। তার মানে (২০+২০)=৪০ কিমি পথের অনর্থক সময় আর গাড়িভাড়া অপচয় করা। তাই ডুয়ার্স ভ্রমণে চালসার গুরুত্ব অপরিসীম। চালসার আশেপাশে গৌরিগাঁও, মহাবাড়ি, বাতাবাড়ি, পানঝোড়া, ধুপঝোড়া ও মূর্তি তে থাকলে তুলনামূলক কম খরচে আর কম সময়ে ঘোরা যায়।
তবে যারা হিল ডুয়ার্সে ২ রাত কাটাতে চান। তারা কোলাখাম, লাভা, রিশপ বা লোলেগাঁও এ রাত্রি যাপন করে হিল ডুয়ার্সের বাকি স্হানগুলো ঘুরে নিতে পারেন। আর যাদের হাতে সময় কম। ৪/৫ দিনে ডুয়ার্সের প্রধান জায়গা গুলো দেখে নিতে চান, তাদের জন্য সমস্ত জায়গার গুরুত্ব ও সৌন্দর্য আলোচনা করা হল।
তার আগে আর একটা কথা স্মরণ করানো যাক, ডুয়ার্সে যারা ঘুরতে আসেন, তাদের মধ্যে বেশ কিছু পর্যটক শেষ দিন নিউ আলিপুরদুয়ার থেকে ট্রেন ধরে। কেউ আবার নিউমাল বা এনজিপি থেকে ফেরার ট্রেন ধরে। প্রায় সব হোটেল থেকেই চেক আউট এর পর একটা দীর্ঘ সময় প্লাটফর্মে অপেক্ষা করতে হয় ট্রেন ধরার জন্য। অথচ বেশ কিছু জায়গা আছে, যেগুলো চেক আউট এর পর অনায়াসে ঘুরে নেওয়া যায় শেষ দিন। তাতে সময়ও কাটে আবার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা তে নতুন পালকও জোড়ে। আমরা তাই শেষ দিন সেরকম কিছু জায়গার হদিশ দেই। যেগুলো তে ঘুরে পর্যটকরা এক রাশ মজা ও সুখ স্মৃতি নিয়ে ট্রেন ধরতে পারে।

চালসা ভিউ পয়েন্ট

চালসা স্টেশন থেকে না বাসস্টপ থেকে ১ কিমির ও কম দূরত্বে চালসার সর্বোচ্চ স্হান চালসা ভিউ পয়েন্ট। উচ্চতা ১৬৩ মিটার। বেশ সাজানো, গোছানো ছিমছাম পার্ক। চাপরামারি আর গোরুমারা ফরেস্টর বহু দূর প্রান্ত অবধি দৃশ্যমান চালসা ভিউ পয়েন্ট থেকে। রাতের বেলায় চালসা শহরের আলোর বিন্দু গুলো কিংবা নিচ দিয়ে বয়ে চলা ছুটন্ত ট্রেনের মজা খুবই উপভোগ্য। একটু হাঁটলেই চা বাগান শুরু। অসাধারণ দৃশ্যপট।

গৌরিগাঁও

চালসার অনতিদূরেই ডুয়ার্স পর্যটনের নবতম আকর্ষণ গৌরিগাঁও। চালসা স্টেশন থেকে ১ কিমিরও কম দূরত্বে শাল, সেগুন, সুপারি, গামারি, শিমুল, শিরিষ গাছের জঙ্গল সমৃদ্ধ ছোট পাহাড়টি গৌরিগাঁও। আসল উচ্চারণ গৈরিগাঁও। নেপালি ভাষায় ‘দারা’ শব্দের অর্থ উঁচু আর ‘গৈরি’ (গ্যহরিও হতে ও পারে) শব্দের অর্থ নিচু।
মাটি থেকে প্রায় ২০-২৫ তলা উঁচু হলেও গৌরিগাঁও চাপরামারি ফরেস্টের কোল ঘেঁষে একটু নিচুতে। আর দারাগাঁও একটু উপরে। দারাগাঁও এর অপর নাম পাদ্রীকোঠি। (পরে আলোচিত হবে।) আর গৈরিগাঁও অপভ্রংশ হয়ে হয়ে হয়েছে গৌরিগাঁও।

পাহাড়, জঙ্গল আর চা বাগান এই তিনের সমাহার গৌরিগাঁও তে। গৌরিগাঁও এর প্রতিটি অংশ থেকেই চালসা ভিউ পয়েন্টের মতন প্যানারমিক ভিউ পাওয়া যায়। দূরের ১৮০ ডিগ্রি জঙ্গল, অনেক নিচ দিয়ে বয়ে চলা রেললাইন, কালো পিচ ঢালা ন্যাশানাল হাইওয়ের এত সুন্দর ভিউ সামনে না আসলে বোঝা যাবে না। ধাপ কেটে কেটে বসতি গড়ে উঠেছে। পাহাড়ি শৈলী তে নির্মিত বাড়ি গুলোও অসাধারণ। ৯০% গ্রামবাসীই নেপালী। প্রতিটি বাড়িতে রঙিন নানা অর্কিডের বাগান। গ্রামের প্রধান আকর্ষণ কিলকুট চা বাগান আর টেবিল টপ আর রবার গার্ডেন।
উত্তর বঙ্গের অন্যতম সেরা চা বাগান হল এই কিলকুট চা বাগান। দু’দিকে সুউচ্চ পাহাড় আর মাঝে তরঙ্গায়িত চা বাগান আপনাকে সামান্য সময়ের জন্য হলেও উত্তর বঙ্গের মিরিক বা দক্ষিণ ভারতের মুন্নার কে মনে করাবে।
এই চা বাগানের সর্বোচ্চ অংশ কে বলে টেবিল টপ। টেবিল টপের এক প্রান্ত চাপরামারি ফরেস্টের সাথে মিশে গেছে। টেবিল টপ থেকে মূর্তি নদীর জল পর্যন্ত দেখা যায়। সারাবছর এখানে আসা গেলেও বর্ষাকালের সৌন্দর্য সব থেকে সুন্দর। কিলকুট চা বাগানের মধ্যে দিয়ে যাওয়া একমাত্র পাহাড়ি নালাটার সৌন্দর্য ও তখন অসাধারণ লাগে। এছাড়া আছে একটা ঝর্ণা। এই গ্রামের জলের প্রধান আকর্ষণ।
তবে বর্ষায় লেপার্ড আর হাতি হানা দেয় সন্ধার পর। তাই সূর্যাস্তের পর এই স্হানে আসা উচিত না। তবে দিনের বেলায় আকাশ পরিস্কার থাকলে এর সৌন্দর্য অবর্ননীয়। হিমালয়ের পাহাড়গুলো এত সুন্দর ভিউ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। টেবিল টপ ছাড়া আছে একটা স্কুল, চার্চ আর রবার গার্ডেন। কিভাবে রবার গাছ থেকে রবার সংগ্রহ হয় আর তা জ্বাল দিয়ে রবারের চাদর তৈরি করা হয়, তা গৌরিগাঁও না এলে বোঝা সম্ভব নয়।

পাদ্রীকোঠি

গৌরিগাঁও এর ঠিক উপরে দারাগাঁও। তবে কোনো এক পাদ্রীর অবস্থান মাহাত্ম্যে এই গ্রামের আজ নাম পাদ্রীকোঠি। ঘন অরণ্য, চা বাগান, চাষের জমি, পশুচারণ ক্ষেত্র এই নিয়ে পাদ্রীকোঠি। তবে প্রধান আকর্ষণ একটি বাহারি বাঁশের বাগান। এই স্হান থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের ছবি অসাধারণ লাগে।
প্রতিটি বাড়ি পাহাড়ি শৈলী তে নির্মিত। নানা রঙের অর্কিড শোভা পাচ্ছে প্রতিটি বাড়ির বাগান থেকে। তবুও প্রচারের অভাবে আজও গ্রামটি লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গেছে।

চাপড়ামারি ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি

চালসা থেকে প্রায় ৬ কিমি দূরে প্রায় ৯৬০ হেক্টর জঙ্গল নিয়ে চাপড়ামারি অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। লাটাগুড়ি থেকে দূরত্ব প্রায় ২৬ কিমি। অতীতে জলঢাকা আর মূর্তি নদীতে চাপড়া মাছ পাওয়া যেত। যা এখন লুপ্ত। এই দুই নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা এই অভয়ারণ্যের নাম তাই চাপড়ামারি।
মূল গেল চালসা থেকে ৬ কিমি দূরে হলেও চালসা থেকে ৩ কিমি দূরেই মূর্তি নদীর পাড়ে অবস্হিত পানঝোড়া থেকেই ফরেস্ট শুরু। শাল, সেগুন, জারুল, শিরিষ, নিম, টুনা ইত্যাদি গাছের ঘন জঙ্গল। ১৯৭৬ সালে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের শিরোপা পেয়েছে। এখানে হাতি, লেপার্ড, সম্বর, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, ময়ুর, বাঁদর আর বন্য শুয়োর আর বাইসন, (ভারতীয় গাউর) আছে। এছাড়া আছে হাজারো প্রজাতির পাখি, বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত সাপও রয়েছে।
জঙ্গলের শুরুতে মূর্তি নদী, দূর থেকে দেখা পাহাড় শ্রেণী, কিলকুট চা বাগান আর জঙ্গল চিড়ে বয়ে চলা রেলপথ এই সব নিয়ে চাপাড়ামারি অনন্য। বড় বড় মোটা মোটা গাছের আড়ালে সূর্যালোকও প্রবেশে বাঁধা পায়। এই জঙ্গলের গাছগুলো দেখলে বেশ আদিম মনে হয়। ওয়াচ-টাওয়ার আছে জীবজন্তু বসে দেখার জন্য।

মূর্তি

চালসা থেকে ৮ কিমি দূরত্বে মূর্তি নদীর পাড়ে মূর্তি ট্যুরিস্ট স্পট। অবশ্য চালসা থেকে ৩ কিমি দূরে পানঝোড়াতেই মূর্তি নদীর পাড়ে আর একটা স্পট আছে। চাপড়ামাড়ি ফরেস্টর সমান্তরাল এই নদীর উৎস ন্যাওড়াভ্যালী অভয়ারণ্যে। সামসিং, সুনতালেখোলা হয়ে চাপড়ামারির সমান্তারাল হয়ে মূর্তি চাপড়ামারি আর গোরুমারা দুটো ফরেস্টকেই প্রভাবিত করে একসময় জলঢাকা তে মিশেছে। আকাশ পরিস্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও দৃশ্যমান মূর্তি থেকে। তবে এই ব্যাপারে কিছু টা বিতর্ক আছে। অনেকে বলেন, বরফে ঢাকা ঐ পাহাড় আসলে ভুটানের ডোকালাম পাহাড়ের। বর্ষায় ভয়ঙ্কর হলেও শীতে মূর্তির সৌন্দর্য যেন উপচে পড়ে। নুড়ি, পাথরের উপর দিয়ে তিরতির করে বয়ে যাওয়া সবুজাভ কিংবা কাচের মতন স্বচ্ছ জল আপনাকে মুগ্ধ করবেই। পাশেই সরু ব্রিজ পাড় হলেই চাপড়ামারি জঙ্গল। নদী তটে হাতি বা বাইসন এর যখন তখন বেরিয়ে আসাও অসম্ভব নয়। সতর্কতা তাই পদে পদে। থাকার জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রচুর হোটেল আছে। নদীর পাড়ে আছে মোমো খাবার কিছু দোকানও।

লাটাগুড়ি

চালসা থেকে মোটামুটি ২০ কিমি দূরে লাটাগুড়ি। লাটাগুড়ি হল গোরুমারা ফরেস্ট এর প্রবেশপথ। টিকিট কাউন্টার ও এখানে। অতীতে চালসাতেও টিকিট কাউন্টার ছিল। পরবর্তী সময়ে চালসা থেকে টিকিট কাউন্টার তুলে দেওয়া হয়। এখন অবশ্য মূর্তিতেও টিকিট কাউন্টার আছে।
আসলে পর্যটকদের কাছে লাটাগুড়ির আকর্ষণ কিছু টা গোরুমারা ফরেস্ট এর নৈকট্যের কারনেই। প্রচুর রিসর্ট আর হোটেলও গড়ে উঠেছে লাটাগুড়ির কাছে। তবে জঙ্গলের নিকটে থাকার যে সৌন্দর্য এতদিন টের পাওয়া যেত, বর্তমানে ফ্লাইওভার হয়ে যাবার পর বেশ কিছু টা যেন ভাটা পড়েছে। কাছাকাছির মধ্যে একটা ছোট মহাকাল মন্দির, ন্যাওড়া নদীর পাড় আর ছাওয়াফেলি ছাড়া সেরকম কিছু নেই। তবু আজও লোকে ডুয়ার্স বলতে লাটাগুড়িকেই বোঝে। অতীতে এখানে বহু কাঠ চেড়াই কল ছিল। স্হানীয় ভাষায় ‘লাঠা’ মানে কাঠের গুড়ি। সেই থেকে লাটাগুড়ি নামের উৎস।
লাটাগুড়ি তে গোরুমারা ও চাপরামারি ফরেস্ট এর প্রবেশ টিকিট মিললেও এখানে থাকা কিছু টা যেন পিছিয়ে থাকার মতন। আসলে লাটাগুড়ি তে থেকে যেখানেই যান না কেনো, আপনাকে ২০ কিমি গিয়ে চালসা হয়েই যেতে হবে। তার ফলে আসতে যেতে ৪০ কিমি পথ চলার জ্বালানি খরচ আর সময় দুটোই অপচয় হয়।

ছাওয়াফেলি

লাটাগুড়ির খুব কাছেই গড়ে উঠেছে ছাওয়াফেলি। ন্যাওড়ানদীর তীরে গোরুমারার জঙ্গলের পাশে এখানকার মুখ্য আকর্ষণ হাতি আর ময়ূর। যদি ও ট্যুরিস্ট মানচিত্র এটি সেভাবে পরিচিতি পায়নি। জঙ্গলের অপূর্ব রূপ আর ন্যাওড়া নদীর সৌন্দর্য আর তার গায়ে গড়ে ওঠা চা বাগান নিয়ে ছাওয়াফেলি।

গোরুমারা ন্যাশনাল পার্ক

প্রায় ১৩০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে গোরুমারা ন্যাশনাল পার্ক অবস্থিত। ১৯৭৬ সালে এটি অভয়ারণ্যের তকমা পায়। আর ১৯৯৪ সালে মর্যাদা পায় জাতীয় উদ্যানের।
কোনো এক সময় এখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব ছিল। কথিত আছে একবার এক হালের গোরুকে বাঘে মারে। তারপর থেকেই এই অঞ্চল টি গোরুমারা নামে খ্যাত হয়। মূলত ন্যাওড়া, মূর্তি, কুূর্তি, জলঢাকা, তিস্তা ও ডায়না ইত্যাদি নদী প্রবাহিত হয়েছে গোরুমারা ফরেস্ট এর মধ্যে দিয়ে।
শাল, সেগুন, পলাশ, জারুল, টুন, নিম, বয়রা ইত্যাদি গাছ নিয়ে গোরুমারা ফরেস্ট গঠিত। প্রানীদের মধ্যে আছে গাউর (বাইসন), গন্ডার, হাতি, লেপার্ড, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, বন্য শুয়োর, বেজি, বন বিড়াল ইত্যাদি। এছাড়া ধনেশ বুলবুলি, ময়ূর সহ নানারকম পাখি।
আর সরীসৃপের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাইথন, কেউটে, ভাইপার, কিং কোবরা ও কচ্ছপ।
প্রাণী আর জীব বৈচিত্রে গোরুমারা জাতীয় উদ্যান আজ অনন্য। বহু প্রাচীন বড় বড় গাছ, অসংখ্য নাম না জানা পাহাড়ি নালা নিয়ে শোভিত হচ্ছে গোরুমারা জাতীয় উদ্যান। জিপসি করে সাফারির ব্যবস্থাও আছে দিনে ৩-৪ টে সিফটে। বহুদিন বন্ধ থাকলেও বর্তমানে আবার হাতি সাফারি ও চালু হয়েছে মূর্তি টিকিট কাউন্টার থেকে। ৫ টি টাওয়ার আছে পশুপাখি দেখার জন্য। মেদলা, চুকচুকি, চন্দ্রচুর, রাইনো ও যাত্রাপ্রসাদ । অবস্থান মাহাত্বে যাত্রাপ্রসাদ ওয়াচ-টাওয়ার বিখ্যাত হলেও বৈচিত্র্যে এগিয়ে মেদলা ওয়াচ-টাওয়ার। এখান কার প্রধান আকর্ষণ মোষের গাড়ি চড়া। গ্রাম, বাংলায় এক সময় যে গোরুর গাড়ি বা মোষের গাড়ির প্রচলন ছিল, তা আজ অবলুপ্ত হলেও একমাত্র মেদলা ওয়াচ-টাওয়ারেই পাওয়া যাবে এই সুযোগ। প্রতিটা ওয়াচ-টাওয়ারে বিকেলের সিফ্টে টিকিট কাটলে পাওয়া যাবে আদিবাসী নাচের মজাও।
এখানে জঙ্গল ঘেঁষা বস্তি গুলোতে রাজবংশী, রাভা, মুন্ডা, মেচ, কোঁচ, ওঁরাও, টোটো সম্প্রদায়ের মানুষের বসতি।

বজরংবলী মন্দির, মাল পার্ক গাজোলডোবা, ভ্রাম্বরি দেবীর মন্দির, জল্পেশ মন্দির, তিনবিঘা

মালপার্ক

মালবাজার বাস স্ট্যান্ডের কাছে মালবাজার মিউনিসিপালিটির আন্ডারে গড়ে উঠেছে এই পার্ক। পর্যটক বিনোদনের নতুন কেন্দ্র। রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। তাতে ঘুরে বেড়ায় হাজারো প্রজাতির পাখি। পুরো পার্কের ডেকোরেশন ও অসাধারণ। রয়েছে বাচ্চাদের খেলার নানা উপকরণ। যারা ডুয়ার্সে বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ট্রেন ধরতে নিউমালে অপেক্ষা করেন। তাদের কাছে সময় কাটানোর সেরা জায়গা মাল পার্ক। তবে শুধু পর্যটকদের কাছেই নয়, স্হানীয় মানুষেদের কাছেও এই পার্ক দারুণ এক এন্টারটেইনমেন্ট।

 

বজরংবলী মন্দির

মালবাজারের উপকণ্ঠে ক্যালট্যাক্স মোড়ের কাছে এই হনুমান মন্দির। অনেকে বালাজী মন্দিরও বলে। অসম্ভব সুন্দর স্থাপত্য শিল্পের বর্তমান নিদর্শন এই বজরংবলী মন্দির।
প্রতি বছর হনুমান জয়ন্তীতে বহুলোক সমাগম হয়। এখানে হনুমানের উপাসনা করা হয় দুটো ভাগে। একটা সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত আর একটা বিকেল ৪ টের পর।
মন্দির গাত্রে ছড়িয়ে আছে হনুমান আর রামায়ণের বিভিন্ন বিষয়ের ছবি। গেরুয়া রঙের কারুকর্ম সারা মন্দির জুড়ে। মালবাজারের মাড়োয়ারি বাসিন্দারা এই মন্দিরটি নির্মান করলেও সকল ধর্মের লোকই আসে মন্দির টি দেখতে। মন্দির টির দুটো তলা। হনুমান ছাড়াও পুজিত হন বিভিন্ন দেবদেবীও।

গাজোলোবা

চালসা থেকে দূরত্ব ৩৭ কিমি। তিস্তা নদীর জলকে ১৯৯৮ সালে ৫৪ টি ফটকের মাধ্যমে বাঁধ দিয়ে জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে গাজোলডোবায়।
বাঁধ দিয়ে এই জলরাশিকে বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন প্রান্তরে খালের মাধ্যমে পাঠিয়ে তা পুনর্বণ্টন করা হয়েছে। এর ফলে কৃষিকাজে সফলতা এসেছে। আসলে সিকিম, বাংলা আর বিহারের লাইফলাইন হল তিস্তা। আর তিস্তাকে বাঁধা দিয়ে যে কর্মকাণ্ড, এটাই তিস্তা ব্যারেজ। তাই নিয়েই তৈরী গাজোলডোবা পর্যটন কেন্দ্র । বাঁধের উপর থেকে ব্রিজের ওপারে আছড়ে পড়ে তিস্তা। তারপর প্রবাহিত হয় বাংলাদেশের দিকে। তাই ব্রিজের উপর বর্ষায় তিস্তার সৌন্দর্য অসাধারণ। বাঁধের উপর ধোঁয়ার মতন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তবে ব্রিজের উপর ছবি তোলা বারণ।
ব্রিজের পশ্চিম পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী তে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন প্রজাতির হাস। তখন তিস্তায় বোটিং ও করে অনেকে।
তবে তিস্তার আর একটা বিশেষ মজা আছে। তা হল এখানকার নদীর টাটকা মাছ। বর্ষাকালে পাওয়া যায় এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত বোরোলি মাছ। যাকে “উত্তর বঙ্গের ইলিশ” বলে। অসম্ভব সুস্বাদু মাছ এই বোরোলি। শুধু তিস্তাই নয়, তোর্সা, জলঢাকা, কালজানি সহ উত্তরবঙ্গের প্রায় সব নদীতেই বোরোলি পাওয়া যায়। তবে শুধু বোরোলি নয়, এখানকার অন্য বেশ কিছু ভালো মাছের আড়ত হল গাজোলডোবা। নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট। অর্ডার করলে টাটকা মাছ ভেজে দেওয়া হয় সমুদ্রের বিচের মতন। “ভোরের আলো” নামে সরকারি রিসর্ট ও হয়েছে থাকার জন্য। এছাড়া আছে কিছু প্রাইভেট লজ থাকার জন্য।

ভ্রামরী দেবীর মন্দির

চালসা থেকে বোদাগঞ্জের দূরত্ব ৬৩ কিমি প্রায়। ৫১ সতীপীঠের অন্যতম ভ্রামরী দেবীর মন্দিরের অবস্থান এই বোদাগঞ্জের জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায়।
মন্দির টি আসামের কামাক্ষা মন্দিরর আদলে তৈরী। কথিত আছে এখানে সতীর বাম পা পড়েছিল। তবে এই মন্দিরের অবস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে।
অনেকের মতে তিস্তা নদীর পাড়ে ফালাকাটার কাছে ধুপগুড়ি ব্লকের পুরানো শালবাড়িতে আসল ভ্রামরী দেবীর মন্দির আছে। তিস্তা নদীর তিন ধারার মাঝে এই মন্দির আছে বলে একে ত্রিস্রোতাও বলে।
তবে অবস্থান মাহাত্ম্য যাই হোক না কেনো, বোদাগঞ্জের এই মন্দির টি কিন্তু বৈচিত্র্যময়। মূল ভ্রামরী দেবীর মূর্তি ছাড়াও পুরো মন্দির জুড়ে রয়েছে অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি।

তবে এই মন্দিরের একটা বিশেষত আছে। দুটি আলাদা গাছ কিছুটা উপরে উঠে হঠাৎ করে মিশে গিয়ে একটা গাছের সৃষ্টি করেছে। এটা এক চরম বিষ্ময়।

জল্পেশ মন্দির

চালসা থেকে ৪৭ কিমি আর ময়নাগুড়ি থেকে ৭ কিমি দূরে জরদা নদীর তীরে জল্পেশ মন্দির। ভৈরব বাবা শিবের লিঙ্গ এখানে পুজিত হয়। তবে তা জললিঙ্গ। মানে গর্তের ভিতর অবস্হিত। বাইরে থেকে দেখা যায় না। তাই তাকে অনাদি বলে।
কোচবিহার রাজা বিশ্ব সিংহ ১৫২৪ সালে এই মন্দির নির্মাণ করেন। ১৫৬৩ সালে তার পুত্র নর নারায়ণ এই মন্দিরের পুনর্নির্মাণ করেন। তবে পরবর্তী কালে অনেকবারই বিভিন্ন রাজার হাতে এই মন্দির সংস্কার হয়েছিল।
প্রতি বছরই শিবরাত্রি উপলক্ষে বহুভক্তের সমাগম হয়। এছাড়া জুলাই আগষ্ট মাসে মানে বাংলার শ্রাবণ মাসে শ্রাবণী মেলায় লক্ষ লোকের সমাগম হয়। উত্তরবঙ্গের এই শ্রাবণী মেলা অন্যতম বড় মেলা।

তিনবিঘা করিডোর

তিনবিঘা করিডোর ঠিক ডুয়ার্সের অংশ না হলেও একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্হান, যা কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ ব্লকের অন্তর্ভুক্ত এবং বাংলাদেশের লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার সীমান্তে অবস্থিত।
এই তিনবিঘা নামটি বিতর্কিত তিন বিঘা জমি থেকে এসেছে। ১৯৭৪ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দীরা গান্ধী এবং বাংলাদেশের শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক ছিটমহল বিনিময়ের যে চুক্তি হয়েছিল, সেখান থেকেই নানা সমস্যা তৈরী হয়। “তিনবিঘা” নামক ছোট ভূখণ্ডটি নিয়ে বিবাদ গড়ায় বহু বছর অবধি। পরবর্তী কালে ২০১২ সাল নাগাদ বাংলাদেশের দহগ্রাম, আঙ্গরপোতা ও দক্ষিণ বেরুবাড়ি যাবার জন্য ভারত সরকার এই তিন বিঘা জমিটি বাংলাদেশ কে ইজারা হিসেবে দেয়। আর বিতর্কের অবসান ঘটে। আগে এই ভারতীয় ভূখন্ড দিয়ে মাত্র ১২ ঘণ্টা চলাচলের অনুমতি থাকলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নির্ধারিত চুক্তির পর এটিকে ২০১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য ই খুলে দেওয়া হয়। উপকৃত হয় ঐ ছিটমহল গুলোর মানুষজন। তবে নিরাপত্তার কড়াকড়ি আছে।

লাল ঝামেলা বস্তি – জলদাপাড়া -সাউথ খয়েরবাড়ি -টোটোপাড়া

চাপরামারি ও গোরুমারার পাঠ চুকিয়ে এবার আমরা মধ্য ডুয়ার্স নিয়ে আলোচনা করবো।
প্রথমেই আসি লাল ঝামেলা বস্তি প্রসঙ্গে।

লাল ঝামেলা বস্তি

চালসা থেকে প্রায় ৩০ কিমি দূরে ভারত-ভুটান সীমান্তে ডায়না নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লাল ঝামেলা বস্তি। “বস্তি” বলা হলেও আসলে কোনো বসতি বা বস্তি নেই আশেপাশে। চালসা থেকে লুকসান চা বাগান এসে কিছুটা এগিয়ে জাতীয় সড়ক ছেড়ে বামদিকে চ্যাংমারি রেল স্টেশন পেরিয়ে কিছু টা গেলেই ডায়না নদীর তীরে গড়ে উঠেছে এই পর্যটন কেন্দ্র। বর্ষা কালে ভয়ঙ্কর হলেও শীতে ডায়না শান্ত, স্নিগ্ধ ও রূপ যোবনে উ্বচ্ছলা।
চওড়া নদী খাতে নুড়ি, বালির উপর দিয়ে পরিস্কার স্বচ্ছ জল। পিছনে সারি সারি পাহাড়। ব্রিজের ওপারে ভুটান। আর এপারে ভারত। মাঝে ব্রিজ সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে চলে যেতে পারেন ভুটানের দর্শনীয় স্হান সামৎসি। শীতে পিকনিকের আসরও বসে ডায়নার চরে। সূর্যাস্ত ও মনোরম ডায়নার চর থেকে।

চামুর্চি

চালসা থেকে ৩৩ কিমি দূরে ডায়নার পূর্ব পাড়ে চামুর্চি। নিকটবর্তী স্টেশন বানারহাট। প্রায় ২৩ টি আশেপাশের চা বাগান নিয়ে চামুর্চি গড়ে উঠেছে। একদিকে ডায়না নদী, উত্তরে ভুটানের পাহার আর দিগন্তজোড়া চা বাগান নিয়ে চামুর্চি এক ছবির মতন ছোটো গ্রাম। বর্তমানে একটি ইকো পা্ক গড়ে উঠেছে। অসম্ভব সুম্দর প্রকৃতির মাঝে চামুর্চি। একটু এগোলেই ভুটানের গেট। ভারত- ভুটানের মাঝে যে ১৮ টা গেট আছে। এটি তার অন্যতম। ওপারে রয়েছে ভুটানের সামৎসি। ইচ্ছে হলে ঘুরেও আসা যায়। প্রতিবছর বানিজ্যের জন্য ভুটানের নাগরিকরা নেমে আসে ঐ পথ দিয়ে।
চামুর্চি থেকে ৩ কিমি গেলে মিউজিক্যাল স্টোন কেভ। এখানে একটি বড় শিবমন্দির আছে। স্হানীয় মানুষের কাছে নাম মহাকাল। সারাবছর ভক্তসমাগম হয়। তবে বর্ষাতে রাস্তা জলে ডুবে যায়।

জলদাপাড়া

চালসা থেকে ৬৩ কিমি পূর্বে আলিপুরদুয়ার জেলায় পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এটি বর্তমানে একটি জাতীয় উদ্যান। তোর্সা নদীর তীরে অবস্থিত এই অভয়ারণ্যের সামগ্রিক আয়তন ১৪১ বর্গ কিলোমিটার। জলদাপাড়া মূলত সুবিস্তৃত তৃণভূমি। এখানে সাবানা ঘাসের মতন বড় বড় ঘাস আর লতা ও গুল্মের জঙ্গলই দেখা যায়। গোরুমারা ন্যাশানাল পার্কের মতন বড় বড় বৃক্ষ জাতীয় বনাঞ্চল এখানে কম। গোরুমারা ফরেস্ট এর মতন এখানেও অবলুপ্তপ্রায় এক শৃঙ্গ গন্ডারের প্রজনন করানো হয়।
বর্তমানে আসামের কাজিরাঙার পর একমাত্র এখানেই একশৃঙ্গ গন্ডার অধিকমাত্রা তে দেখা যায়।
গন্ডার ছাড়াও হাতি, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, লেপার্ড, বাইসন (গাউর), বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ দেখা যায়।

জলদাপাড়া বিভিন্ন পাখিরও স্বর্গরাজ্য। ভারতের যে অল্প কয়েকটি অঞ্চলে বেঙ্গল ফ্লোরিক্যান দেখা যায়, তার মধ্যে জলদাপাড়া অন্যতম। এখানে দেখা যায় এমন অন্যান্য পাখিগুলি হল ক্রেস্টেড ইগল, পালাস’স ফিশিং ইগল ও শিরকা। এছাড়া দেখা যায় বনমোরগ, ময়ূর, তোতা, বেঙ্গল ফ্লোরিক্যান, লেসার পেইড হর্নবিল প্রভৃতি।
এখানে সরীসৃপের ভেতরে আছে অজগর, গিরগিটি, ক্রেট, কোবরা ও বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ।
তবে বর্তমানে জলদাপাড়া তে রয়াল বেঙ্গল টাইগার বিলুপ্তির পথে।

টোটোপাড়া

চালসা থেকে ৮৩ কিমি আর জলদাপাড়া থেকে 23 কিমি দূরে হিমালয়ের পাদদেশে এক অনন্য সুন্দর গ্রাম টোটো পাড়া। তবে প্রকৃতির শোভাই শুধু নয়, টোটো পাড়া বিখ্যাত এখানকার টোটো উপজাতিদের জন্য। এরা ক্রমশঃ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক উপজাতি। একটা দীর্ঘ সময় এরা সভ্য জগতের আড়ালে ছিল। আস্তে আস্তে সভ্যতার আলোকে এসেছে। আগে এদের জীবন যাত্রা দেখার জন্য পর্যটকরা হানা দিত। তাতে এই সম্প্রদায়ের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তো। বর্তমানে এরা সুশৃঙ্খল হওয়ায় আর শিক্ষার আলোকে প্রবেশ করায় বর্তমানে এরা বাইরে জগতের সাথে ওঠাবসাও করছে। এদের বাড়ি ঘর গুলো সাধারণত রাস্তার ঠিক উল্টোমুখি। যাতে বাইরের লোকের পক্ষে নিজেদের জীবনযাপন সম্পর্কে কমই জানতে পারে।

সাউথ খয়েরবাড়ি পার্ক

চালসা থেকে ৬৭ কিমি আর জলদাপাড়া থেকে ১৫ কিমি দূরে খয়েরবাড়ি ফরেস্টের দক্ষিণে তোর্ষা নদীর ধারে এই পশু উদ্ধার কেন্দ্র অবস্হিত। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আহত বাঘ, চিতাবাঘ ও অন্যান্য পশুদের চিকিৎসার জন্য এখানে আনা হয়। একসময় সুন্দরবনে কুমিরের হাতে থাবা খোয়ানো রাজা নামের একটা বাঘকেও এখানে আনা হয়। খুন জনপ্রিয় হয় রাজা।
আস্তে আস্তে এই পার্ক রূপ নেয় চিড়িয়াখানার। গড়ে ওঠে প্রতিটি লেপার্ড আর বাঘের জন্য আলাদা আলাদা এনক্লেভও। পুরো রেসকিউ সেন্টারের চারদিকে গভীর পরিখা কাটা। গাছ পালাও প্রচুর। ব্যাটারি চালিত গাড়িতে লেপার্ড সাফারিও হত একসময়। সব মিলিয়ে এক বিনোদন কেন্দ্র। তবে শিলিগুড়ির অদূরে বেঙ্গল সাফারি পার্ক হবার পর বেশির ভাগ জন্তুজানোয়ার কে সরিয়ে দেওয়ায় কোথায় যেন এই পার্ক আজ জৌলুশ হীন।

ফুন্টশোলিং

চালসা থেকে প্রায় ৯২ কিমি দূরে ফুন্টশোলিং। এপারে ভারতের জয়গাঁও আর ওপারে ভুটানের ফুন্টশোলিং। মাঝে সুদৃশ্য প্রবেশদ্বার। বাঙালী এখনো ডুয়ার্সে আসলে একবার ছুঁয়ে দেখে নিতে চায় এই তোরণদ্বার কে।
ভারতবাসীরা তোরণদ্বার দিয়ে ভিতরে অবলীলায় প্রবেশ ও করতে পারে। একমাত্র থিম্পু, পারো বা ভুটানের অন্য স্টেটে প্রবেশ করতে গেলে পেপার বানাতে হবে।
ফুন্টশোলিং এর ভিতরে আছে একটা মনাস্টেরি আর ক্রোকোডাইল পার্ক। যারা ডুয়ার্সে আসেন, তারা এই দুটি জায়গায় অবশ্যই ঢুঁ মেরে থাকেন। তবে গত দু বছর ধরে করোনার আবহে ফুন্টশোলিং বন্ধ।

কুঞ্জনগর ইকো পার্ক

চালসা থেকে দূরত্ব প্রায় ৮১ কিমি। বুড়ি তোর্ষার তীরে গড়ে ওঠা এই পার্ক একসময় রমারমা ছিল। বর্তমানে সব কিছু ফাঁকা। জীবজন্তু তো নেয়ই। খালি খাচা গুলো পড়ে আছে। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুব সুন্দর। জলদাপাড়া জঙ্গল সংলগ্ন এই পার্কে প্রচুর গাছগাছালির মেলা। বাচ্চাদের পার্কও আছে। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধুঁকছে।

নলরাজার গড়

চিলাপাতা জঙ্গের গভীরে রয়েছে এক প্রাচীন দূর্গ। যদিও এখন ইটের স্তুপ ছাড়া আর কিছুই নেই। কোচবিহারের রাজা চিলা রায় এই গড়ের নির্মাতা হলেও পরবর্তী কালে রাজা নরনারায়ণ এর নাম থেকে অপভ্রংশ হয়ে নল রাজার গড় বলে ইতিহাসে খ্যাত হয়। ইটের ভগ্নস্তূপ হলেও প্রকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। পর্যটকরাও আসে গড় দেখতে।

চিলাপাতা

চালসা থেকে দূরত্ব প্রায় ৮৪ কিমি।
কোচবিহার রাজা চিলা রায়ের নাম অনুসারে ‘চিলাপাতা’ নামটি হয়। আসলে চিলাপাতা কোনো পৃথক জঙ্গল নয়। এটি জলদাপাড়া আর বক্সা ফরেস্টের মাঝামাঝি হাতি করিডোরের উপযুক্ত একট গভীর জঙ্গল। একটা সময় কোচবিহার রাজারা এখানে শিকার করতে আসত। তখন গন্ডারের সংখ্যাধিক্য ছিল। বর্তমানে বিলুপ্ত না হলেও সংখ্যা অনেক নকমে এখানে। এছাড়া লেপার্ড, হাতি, বাইসন (গাউর), বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ এ জঙ্গলে রয়েছে। আর রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির হরিণও।
চিলাপাতা আসলে গভীরে জঙ্গল। তাই পর্যটকদের কাছে আকর্ষণ ও বেশী। জঙ্গলের গভীরে বুড়ি তোর্ষা নদীর পাড়ে রয়েছে এক নজর মিনার। দিনের বেলাতেই ঘুরে বেড়ায় দাঁতালের দল।
একদিকে তোর্ষা, আর একদিকে কালজানি এই দুই নদী চিলাপাতাকে ঘিরে রেখেছে। এছাড়া আছে বানিয়া রিভারও। নদীর আশেপাশে প্রচুর বেসরকারী রিসর্টও হয়েছে।

কোচবিহার রাজবাড়ী

চালসা থেকে দূরত্ব প্রায় ১১০ কিমি।
কোচবিহার রাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ এর সময়ে নির্মিত স্থাপত্যের এক অভুতপূর্ব নিদর্শন কোচবিহার রাজবাড়ি যা আদতে লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসের অনুকরণে নির্মিত। একে কোচবিহার প্যালেস ও বলে ডাকে কেউ কেউ। আবার একে অনেকে ভিক্টর জুবিলী প্যালেসও বলেন। অসম্ভব সাজানো গোছানো একটি প্রাসাদ। মূল গেট থেকে সবুজ গালিচা পাতা রাস্তা। দুধারে বাহারি গাছের মেলা। একটা মিনি চিড়িয়াখানাও আছে। সেখানে খরগোশ আর বিভিন্ন রকম পাখিদের রাখা হয়েছে।
ভবনটি মোট ৫১,৩০৯ বর্গফুট এলাকার উপর অবস্থিত। বাড়িটি ৩৯৫ ফুট দীর্ঘ ও ২৯৬ ফুট প্রশস্ত। এর উচ্চতা ৪ ফুট ৯ ইঞ্চি। ভবনের কেন্দ্রে একটি সুসজ্জিত ১২৪ ফুট উঁচু ও রেনেসাঁ শৈলীতে নির্মিত দরবার হল রয়েছে। এছাড়া বাড়িতে রয়েছে ড্রেসিং রুম, শয়নকক্ষ, বৈঠকখানা, ডাইনিং হল, বিলিয়ার্ড হল, গ্রন্থাগার, তোষাখানা, লেডিজ গ্যালারি ও ভেস্টিবিউল। যদিও এই সব ঘরে রাখা আসবাব ও অন্যান্য সামগ্রী এখন হারিয়ে গিয়েছে। বহিরাগতদের জন্য রেস্ট্রিকশন ও আছে পদে পদে।
এই মিউজিয়ামে রয়েছে কোচবিহার রাজাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। স্হানীয় আদিবাসী সমাজের ব্যবহৃত জিনিসপত্রও। বেশ কিছু তৈল চিত্রও। অন্যান্য মিউজিয়ামের মতন রয়েছে নিরাপত্তা কর্মীদের কড়াকড়ি। তবে প্রতি শুক্রবার বন্ধ থাকে মিউজিয়াম। কোচবিহার এসে একটা টেটো বা অটো রিজার্ভ করেই ঘুরে নেওয়া যায় কোচবিহার আর মদনমোহন মন্দিরও।

মদনমোহন মন্দির

কোচবিহার শহরের কেন্দ্রেই রয়েছে এই মদনমোহন মন্দির।
বর্তমানে ২০৬ বছরের পুরনো এই মন্দির ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ। আকৃতিতে মন্দিরটি চারচালা। জানা যায়, মদনমোহনের বিগ্রহটি আদতে কোচবিহারের মহারাজের গৃহদেবতা। বর্তমানে রুপোর সিংহাসনে নানা আভরণে ভূষিত রয়েছেন অষ্টধাতুর মদনমোহন। এখানে “রাস” উৎসব খুব জনপ্রিয়। প্রচুর জনসমাগমও হয় তখন। যারা কোচবিহারে আসেন, তারা কনডাক্টেড ট্যুরে এই মন্দির দেখে নেয়।

রসিক বিল

চালসা থেকে দূরত্ব ১৪১ কিমি। কোচবিহার জেলার এই জঙ্গল ঘেঁষা লেকটি প্রোপার ডুয়ার্সে না পড়লেও পর্যটক দের অন্যতম আকর্ষণ। নিকটতম স্টেশন কামাক্ষাগুড়ি। প্রধান আকর্ষণ এই লেকের কচ্ছপ। আসলে এটি একটি কচ্ছপ উদ্ধার কেন্দ্র। বিভিন্ন বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির কচ্ছপের বিডিংও হয় এখানে।
তবে শুধু কচ্ছপ নয়। লেকের পাড়ের অসংখ্য গাছে বাসা বেঁধে বাস করে অসংখ্য পাখিও। তার মধ্যে বক, সারস, মাছরাঙা আছে। শীতে পরিযায়ী পাখিরাও আসে দলবেঁধে।
লেপার্ড আর পাইথনের একটা ছোটো চিড়িয়াখানাও আছে।

রাজাভাতখাওয়া-বক্সা-লেপচাখা- বক্সা ফোর্ট – জয়ন্তী- পোখরি লেক- সিকিয়াঝোড়া

 

রাজাভাতখাওয়া

চালসা থেকে ১১২ কিমি দূরে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প আর জয়ন্তী যাবার প্রবেশদ্বার হল রাজাভাতখাওয়া।
বক্সা ও জয়ন্তী যাবার টিকিটও পাওয়া যায় এখান থেকেই। সর্বোচ্চ ৩ দিনের জন্য এন্ট্রি পাশ দেওয়া হয়।

জনশ্রুতি আছে ভুটানের রাজাকে বাংলা ছাড়া করতে কোচবিহারের রাজা ১৮০০ সালে ঠিক এই স্হানে প্রতিজ্ঞা করেন, যতক্ষণ তিনি ভুটান রাজ কে যুদ্ধে পরাস্ত করে বহিষ্কার না করেন, ততদিন তিনি অন্ন বা ভাত স্পর্শ করবেন না। যদি ও শেষ পর্যন্ত ভুটান রাজ পিছু হটে মিত্রতা স্বীকার করেন আর তিনিও ভাত খান। সেই থেকে এই স্হান রাজাভাতখাওয়া।
এমনিতে তিনদিকে জঙ্গল ঘেরা এক অপূর্ব জনপদ। টিকিট কাউন্টারের সামনেই আছে প্রজাপতি মিউজিয়াম। যা পর্যটক বিনোদনের অন্যতম আকর্ষণ।

 

বক্সা ফরেস্ট

বক্সা ফরেস্ট টি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর -পূর্ব সীমান্তে সিঞ্চুলা পর্বত শ্রেনীর পাদদেশে অবস্হিত। মোটামুটি আয়তন ৭৫০ বর্গকিলোমিটার। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা কোথায়ও ১৫২ মিটার, কোথায়ও ১৭৫৫ মিটার। সিঞ্চুলা পর্বত মালার ভারতীয় অংশ বক্সা পাহাড়ের পাদদেশে বলে এই জঙ্গলের নামও বক্সা। এটির উত্তরে রয়েছে ভুটানের ফিপসু অভয়ারণ্য। পূর্বে রয়েছে আসামের মানস জাতীয় উদ্যান আর দক্ষিণ- পশ্চিমে রয়েছে চিলাপাতা ফরেস্ট। বর্তমানে উত্তরবঙ্গের একমাত্র এই অঞ্চলেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখা যায়। ব্যাঘ্র প্রকল্পও গড়ে উঠেছে তাই।
এখানে ৩০০ প্রজাতির গাছ লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে বৃক্ষ, গুল্ম, ঘাস, সাবানা ও জলজ প্রকৃতির উদ্ভিদ দেখা যায়। গাছের মধ্যে শাল, বাঁশ, গামারি, চাপা, শিমুল এগুলো লক্ষনীয়।
প্রানীদের মধ্যে এখানে এশীয় হাতি, বাঘ, গউর, বুনো শুয়োর, সম্বর হরিণ দেখা যায়। এছাড়া এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, বিভিন্ন রকম সাপ ও উভচর প্রাণীও রয়েছে। এছাড়া এখানকার নদী গুলোতে বিভিন্ন রকম মাছও দেখা যায়। এখানে ভালুক, সিভেট, দৈত্যাকার কাঠবিড়ালী, চিতল, ক্লাউডেড চিতাবাঘ, বুনো মোষ, ও অ্যান্টিলোপও দেখা যায়। এবছর তো ট্র্যাপ ক্যামেরায় ব্ল্যাক প্যানথারের ( কাল চিতা) হদিশও পাওয়া গেছে। নদীবিধৌত বক্সার প্রধান দুই নদী রায়ডাক ও জয়ন্তী। এছাড়া আছে পানা, ডিমা, বালা, গাবুর বাসরা, সঙ্কোষ, গদাধর।

বক্সা ফোর্ট

রাজাভাতখাওয়া টিকিট কাউন্টার থেকে বক্সা ফরেস্ট হয়ে সান্তালাবাড়ির দূরত্ব ১৫ কিমি। গাড়ি চলা এখানেই শেষ। এরপর পায়ে হেঁটে যেতে হবে বক্সা ফোর্ট। জঙ্গলাকীর্ণ ৪ কিলোমিটারের পাহাড়ি দূর্গম রাস্তা। তারপর ফোর্ট। এই ফোর্ট কারা বানিয়েছিল, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে অতীতে ভুটান রাজা আর কোচবিহারের রাজাদের মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে এই ফোর্ট বিখ্যাত হয়। ১৮৬৩ নাগাদ ভুটান রাজাদের কাছ থেকে ইংরেজ দের সহায়তায় কোচবিহার রাজ এই ফোর্ট ফিরে পেলেও তা পরবর্তী কালে ব্রিটিশদের অধিনে আসে। 👉👉👉 রাজাভাতখাওয়া-বক্সা-লেপচাখা- বক্সা ফোর্ট – জয়ন্তী- পোখরি লেক- সিকিয়াঝোড়া

লেপচাখা

বক্সা ফোর্ট থেকে আরও ২ কিমি হেঁটে গেলে পড়বে প্রকৃতির মাঝে অনন্য এই পাহাড়ি ছোট গ্রামটি। ভুটানের ড্রুকপা সম্প্রদায়ের মাত্র একশো মতন লোকের বাস।
মনোরম প্রকৃতির অপরূপ শোভা এখানে। সান্তালাবাড়ি থেকেই গাইড নিতে হয় এখানে আসতে হলে। প্রায় ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার রাস্তা। এখান থেকে এরিয়াল দূরত্বে ভুটান মাত্র ২ কিমি। একটা চেক পোস্টও আছে।
লেপচাখার ভিউ পয়েন্ট থেকে পূর্ব ডুয়ার্সের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ দৃশ্যমান। এখানে থাকার জন্য বেশ কিছু হোম স্টে আছে। তাঁবুতে থাকার জায়গাই বেশি। মূলত ট্রেকাররাই আসে বেশি।
এখান থেকেই ট্রেক করে ঘুরে আসা যায় রোভার্স পয়েন্ট, চুনাভাট্টি এবং মহাকাল।

জয়ন্তী

চালসা থেকে দূরত্ব ১১৭.৫ কিমি। আর রাজাভাতখাওয়া চেক পোস্ট থেকে দূরত্ব ১৬ কিমি। জয়ন্তী নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে জয়ন্তী। পূর্ব ডুয়ার্সের পর্যটক আকর্ষণের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। বিশাল চওড়া নদী বক্ষে শীতে জল শুকিয়ে গেলেও সৌন্দর্য অপরিসীম। নুড়ি বিস্তৃত নদী তটে এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বর্ষার জলে ভেসে আসা গাছের গুড়ি এখানকার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে। নদীর ওপারে মাথা তুলে দাঁড়ানো ভুটান পাহাড়। বর্ষাকালে জয়ন্তী অতি ভয়ঙ্কর। তাই ভরা বর্ষায় বন্ধ থাকে নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা হোম স্টে গুলোও। নদীর জল ঢুকে পড়ে উঠোনে।
জয়ন্তীতে জয়ন্তী নদীর মূল আকর্ষণ ছাড়াও আছে আরও নানান ঘোরার জায়গা। কাছাকাছি রয়েছে চুনিয়া ওয়াচ-টাওয়ার, ভুটিয়া ওয়াচ-টাওয়ার, বড় ও ছোটো মহাকাল। অবশ্য নদীখাত পেরিয়ে ওপারে যেতে জিপসি চড়তে হয়।
তবে জিপসি করে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল ভোরে কোর বক্সা সাফারি। জীবজন্তু দেখার সম্ভাবনা ভালোই। এছাড়া এখান থেকেই যাওয়া যায় রায়মাটাং, পোখরি লেক এই জায়গাগুলিও।

পোখরি লেক

জয়ন্তী থেকে ৪ কিমি দূরে পোখরি হিল। ছবির মতন সুন্দর জায়গা। ২ কিমি গিয়ে গাড়ি যাওয়ার পথ শেষ। তারপর আর ২ কিমি পায়ে চলা সহজ পথ। পথ শোভা অতি মনোরম। জঙ্গলাকীর্ণ পথ পেরিয়ে গাইড কে পাশে নিয়ে হিলের টপে পৌঁছলে দেখা যাবে লম্বাটে গড়নের একটা ছোটো পুকুর বা লেক। পুরো জায়গাটাই পাহাড়ি শোভা আর গাছপালায় ভরপুর। বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর কচ্ছপ আর মাগুর মাছের আবাস স্হল। এছাড়া লেপার্ড, হাতি আর মঙ্গুজ জাতীয় পশুদের আনাগোনা লেগেই থাকে।
লেকটি স্হানীয় মানুষের কাছে একটি পবিত্র স্হান। তারা লেকের জলে পা ছোঁয়ানোকেও পাপ মনে করে। প্রতি বৌদ্ধ পূর্ণিমায় তাই পূজো পাঠ চলে সারাদিন ব্যাপি। প্রচুর লোক সমাগমও হয়। শুধু পোখরি লেকই নয়। আসার পথে দেখে নেওয়া যায় TGN ওয়াচটাওয়ারও। ওয়াচ-টাওয়ার থেকে জঙ্গলের ভিউ অসাধারণ।

TGN ওয়াচটাওয়ার

জয়ন্তী থেকে মোটামুটি ৪ কিমি দূরত্বে এই ওয়াচ-টাওয়ার। পুরো নাম তাশি গাঁও ওয়াচ-টাওয়ার। পোখরি লেক যাবার পথে এটা পর্যটকদের কাছে একটা উপরি পাওনা। ঘন জঙ্গলের মাঝে তিনতলা ওয়াচ-টাওয়ার। আর সামনে ছোট লেক। সকাল সন্ধ্যা তে নুন আর জল খেতে আসে হাতির পাল। বক্সা ফরেস্ট এর এক অপরূপ শোভা দেখা যায় এই টাওয়ার থেকে।

মহাকাল

জয়ন্তী থেকে নদী পেরিয়ে ৫ কিমি দূরে মহাকাল মন্দির। মহাকাল বলতে অবশ্য ছোট ও বড় দুটো মন্দির বোঝানো হয়। জয়ন্তী থেকে জিপসি নিয়ে নদীর বালি পাথর পেরিয়ে ওপারের ঘন জঙ্গল দিয়ে রাস্তা চলে গেছে ছোটো মহাকালের। তবে পুরোটা পথ জিপসি ও যায় না। কিছুটা পথ ট্রেক করতে হয়। আর বড় মহাকালের অবস্থান ছোটো মহাকাল থেকে খাঁড়াই পাথরে পথ ভেঙে আরও উপরে একদম ভুটান সীমান্তে। বছরের বেশ কিছুটা সময় ট্রেকিং ও মানা। রাস্তা অতি দূর্গম। পথে হঠাৎ জীবজন্তুর উপস্থিতিও আশ্চর্য নয়।
আসলে মহাকালে কোনো মন্দির নেই। পুরো পাথরের গুহা। তারমধ্যে ভগবান শিবের অবস্থান। তাই শিব চতুর্দশীর দিন প্রচুর ভক্ত সমাগম হয় এখানে। ভারত থেকে তো বটেই, এমন কি নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর জনসমাগম হয় শিব চতুূর্দশীতে।
এই গুহাটি ভারত-ভুটান সীমান্তে হলেও রক্ষণাবেক্ষণ সহ অতিথি সেবার সমস্ত কিছু ভুটান সরকারই করে থাকে। শিব চতুর্দশী হিসেবে দুদেশের সীমান্ত অফিসাররাও মহাকালে সামিল হন মৈত্রীর বন্ধনে।

চুনিয়া ও ভুটিয়া ওয়াচ-টাওয়ার

জয়ন্তী তে পোখরি, বক্সা, মহাকাল বাদ দিলে আর দুটো গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হল চুনিয়া আর ভুটিয়া বস্তি ওয়াচটাওয়ার।
জয়ন্তী থেকেই সকালে আর দুপুরে এই দুই ওয়াচ-টাওয়ারে জিপসি যাবার ব্যবস্থা আছে। জিপসি ছাড়াও বড় সাইজের গাড়ি করেও এই দুই ওয়াচটাওয়ারে যাওয়া যাবে। তবে নদী পেরিয়ে গভীর জঙ্গলের প্রায় ১৪ কিমি দূরে চুনিয়া ওয়াচ-টাওয়ারে ভ্রমণ এক দুঃসাহসিক অভিযান বলা যেতে পারে। নদী তটে বিছানো নুড়ি, বালি আর আলগা বোল্ডারের উপর দিয়ে এই ওয়াচ-টাওয়ার যাত্রা দারুণ এক থ্রিলিং অভিজ্ঞতা সঞ্চার করবে।
চুনিয়া ওয়াচ-টাওয়ারে ২ টো ডেক। উপরে ওঠার জন্য লম্বা সিঁড়ি।
জয়ন্তীর ওপারে চুনিয়া বস্তিতে এই টাওয়ার অবস্হিত। হাতি, লেপার্ড, বাইসন, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ খুব সহজেই দেখার সুযোগ থাকে এখানে
একটু দূরে ভুটিয়া ওয়াচ-টাওয়ার। লম্বা লম্বা পিলারের উপরে নির্মিত তিনটে ডেক বিশিষ্ট ভুটিয়া ওয়াচ-টাওয়ার ভুটিয়া বস্তিতে অবস্হিত। এটা হাতি করিডোরের এমন স্হানে যে, প্রায় প্রতিদিনই হাতিরা এসে টাওয়ারের সামনে ঘুরে বেড়ায়।

সিকিয়াঝোড়া

চালসা থেকে দূরত্ব প্রায় ১১১ কিমি।
একে অনেকে “উত্তরবঙ্গের সুন্দরবন” বা “আমাজন” বলে। নদীর জলকে বাঁধে আটকে তৈরি হয়েছে জঙ্গলের ভিতরে এক জলপথ। নাম হয়েছে সিকিয়াঝোড়া। পর্যটক আকর্ষণের এক উল্লেখযোগ্য স্হান। সরু নদীর ভিতর দিয়ে জঙ্গলের গভীরে বোটে করে অভিযান, এ এক দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। অনেকটা সুন্দরবনের মতন। তবে সুন্দরবনের থেকেও হয়তো কখনো কখনো বিপদজনক। দুধারে লতা, গুল্মের ঘন ঝোপ। আর তার মাঝে মাঝে হঠাৎ বিষধর সাপের উঁকিঝুঁকি। কিংবা হঠাৎ করে সামনে পড়ে গেল নদীর জল খেতে আসা হাতির পাল। এক অজানা ভয় সব সময়ই অপেক্ষা করে সিকিয়াঝোড়ার প্রতিটি বাঁকের মুখে। জঙ্গল পথে এই এক -দেড় ঘণ্টার সাফারি আপনাকে সব সময় আতঙ্কিত করে রাখতে পারে। শুধু হাতি, লেপার্ড, হাতি, গন্ডার বা বাইসন নয়। রয়েছে বিভিন্ন পরিযায়ী পাখির দলও। প্রতি বছরই শীতে ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে আসে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে।
একটা ওয়াচ-টাওয়ার আছে। এখান থেকে দেখে নেওয়া যায় বক্সা ফরেস্টের এই জঙ্গলাকীর্ণ জলাভূমি কে। থাকার জায়গা ও আছে সরকারি কটেজে।

রায়মাটাং

চালসা থেকে দূরত্ব ১০২ কিমি। হাসিমারা থেকে দূরত্ব ১৩.৬ কিমি প্রায়। রায়মাটাং কালজানি নদীর তীরে এক উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র। যারা শহর জীবনে হাঁপিয়ে ওঠে, তাদের কাছে রায়মাটাং এক টুকরো স্বর্গ। আসলে ডুয়ার্সে পাহাড়, জঙ্গল আর নদী পরিবেস্টিত স্হান কম নেই। রায়মাটাং এ উপরিপাওনা ঘন জঙ্গল। বক্সার জঙ্গল একদম কাছে। তাই উত্তরে হিমালয়ের সৌন্দর্য মাাঝে নদী আর পাশে জঙ্গল সব নিয়ে রায়মাটাং। একটা ওয়াচ-টাওয়ার ও আছে। এখানে ২৬৪ রকম পাখির দেখা পাওয়া যায়। তাই পক্ষি বিশারদদের কাছে রায়মাটাং এর গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়া জন্তু জানোয়ার এর মধ্যে হাতি, লেপার্ড, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণের দেখা পাওয়া যায়। শীতে প্রকৃতি শান্ত হলেও বর্ষায় ভয়ঙ্কর। থাকার জন্য বেশ কিছু হোম স্টে ও আছে।

ভুটানঘাট

আলিপুরদুয়ার থেকে ৪৫ কিমি দূরে কুমারগ্রাম ব্লকে ভুটানঘাট অবস্হিত। এটি মূলত ভারত-ভুটান সীমান্তে ভুটান ঘেঁষা বলে এই স্হানের নাম ভুটানঘাট। আসলে এটা বাংলা-আসাম-ভুটান এর সংযোগ স্হলে রায়ডাক নদীর পাড়ে অবস্হিত। একদিকে ভুটান পাহাড়, আর একদিকে বক্সার ব্যাঘ্র প্রকল্প। তার মাঝে রায়ডাক নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ভুটানঘাট। প্রকৃতি এখানে ঢেলে সেজেছে। পাহাড়, জঙ্গল, নদী, চা বাগান সব নিয়ে এক ছবির মতন গ্রাম ভুটান ঘাট। বক্সার জঙ্গল একদম কাছে বলে এটা হাতি আর বাইসনের করিডোর হিসাবে পরিচিত। মাঝেমধ্যে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ও দেখা যায়। তবু সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। তবে একদম ভুটান সীমানে বলে চলা ফেরায় কিছু রেস্ট্রিকশন আছে। বন্ধও থাকে ঘন বর্ষায়।

গারুচিরা

চালসা থেকে ৬৪ কিমি আর আলিপুরদুয়ার থেকে ৮০ কিমি দূরত্বে বান্দাপানি ব্লকে গারুচিরা বা গারোচিরা। নদী পাহাড়, জঙ্গল আর চা বাগান সমৃদ্ধ গারুচিরা হাতি দেখার সেরা ঠিকানা। সুক্তি আর রেতি নদী বয়ে গেছে গ্রামটির উপর দিয়ে। গারুচিরার একপাশে ঘন শাল, সেগুনের জঙ্গল আর অন্য পাশে ভুটানের পাহাড়। এক অপূর্ব সাজানো গ্রাম গারুচিরা। তবে এত সুন্দর হয়েও থাকার ব্যবস্থা অত্যন্ত সীমিত। সরকারি বাংলো ছাড়া কোনো হোম স্টে ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। নিকটবর্তী স্টেশন দলগাঁও। একমাত্র বর্ষা বাদে সারা বছর আসা যায়। ওদলাবাড়ি-মানাবাড়ি-তুরিবাড়ি- পাথরঝোড়া-ইয়েলবং-মানজিং-লুংসেল- ঝান্ডি

ওদলাবাড়ি

চালসা থেকে প্রায় ২১ কিমি দূরে পশ্চিমে লীশ নদী আর পূর্বে চেল নদীর মাঝে গড়ে উঠেছে চা বাগান, জঙ্গল আর নদী সমৃদ্ধ ওদলাবাড়ি। দুই নদীর মাঝে ওদলাবাড়ি মাত্র ২ কিমি চওড়া। উত্তরে ৪ কিমি গেলেই হিমালয় শুরু। মাঝে বিশাল বড় বড় চা বাগান। প্রবাহিত হয়েছে নাম না জানা অসংখ্য পাহাড়ি ঝোড়া। ট্টেনে করে আলিপুরদুয়ার যেতে গেলে নীল পাহাড়, নদী আর চা বাগান আর বিস্তৃত পশুচারণ ভূমির যে ছবি চোখে পড়ে, তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ওদলাবাড়ির উত্তরে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য পর্ঢ়টন কেন্দ্র। চুইখিম, ইয়েলবং, লুংসেল, মানজিং, তুরিবাড়ি, মানাবাড়ি, পাথর ঝোড়া ইত্যাদি।
আর দক্ষিণ প্রান্তে ৫ কিমি গেলেই পড়বে কাঠামবাড়ি ফরেস্ট রেঞ্জের বৈকুন্ঠপুর ফরেস্টও। যা হাতি চলাচলের অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়া কাছেই আছে গাজোলডোবা। যার আলোচনা পরে করা হবে।
ওদলাবাড়ির ৪০ কিমি দূরে শিলিগুড়ি। মাঝে আছে আর এক জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র মংপং। তিস্তা নদীর পূর্ব পাড়ে পাহাড়, জঙ্গল আর চা বাগান ঘেঁষা মংপং এ থাকার জন্য ফরেস্ট লজ আছে। ওদলাবাড়ির কাছাকাছি আছে আছে আরও দুটো স্পট। বাগরাকোট আর ডামডিম। দুটোই দর্শনীয় স্হান।

পাথরঝোড়া

চালসা থেকে ৩১ কিমি আর নিউমাল থেকে ২১ কিমি দূরে ঘিস নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে নতুন এক পর্যটন কেন্দ্র পাথরঝোড়া। রয়েছে বিশাল চা বাগান। বিস্তৃত নদী তট। আকাশ পরিস্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও দৃশ্যমান পাথরঝোড়া থেকে। পাশাপাশি রয়েছে একদম নতুন আরও কিছু পর্যটন স্হল। তুরিবাড়ি, মানাবাড়ি এগুলোও। সব গুলোই নদীর পাড় ঘেষে গড়ে উঠেছে। আছে একটি গল্প ক্লাবও। ওয়েস্ট ডুয়ার্স গল্ফ ক্লাব।

মানজিং

ঝান্ডিদারা থেকে লংসেল হয়ে আরও নিচে নামলে আর এক ছবির মতন সুন্দর গ্রাম মানজিং। এটি এতটাই নতুন, যে সেই অর্থে কোনো থাকার জায়গা গড়ে ওঠে নি। এখানেও দুটো ভিউ পয়েন্ট আছে। আর আছে একটি শিব মন্দির। অপরূপ পাহাড়ি পরিবেশ। প্রায় ঘরে ঘরে লুংসেলের মতন অ্যালাচ চাষ হয়। কাছাকাছি অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান আছে। চেলনদীর তীরে তুরিবারি, নিমবং, পাবং এবং ইয়েলবং। প্রতিটি গ্রাম উত্তরবঙ্গের স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে আপন সৌন্দর্যে ভরপুর। প্রায় সর্বত্রই টেন্ট অ্যাকোমোডেশান চালু হয়েছে। তবে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ইয়েলবং। উচ্চতা অনুযায়ী মানজিং আপার ও লোয়ারে বিভক্ত। এখনো কোনো হোম স্টে বা হোটেল না হলেও টেন্ট অ্যাকোমোডেশান গড়ে উঠেছে।

ইয়েলবং

উত্তরবঙ্গের একমাত্র গ্র্যান্ড ক্যানিওন। বাগরাকোট বা নিউ মাল হয়ে একই দূরত্ব। মোটামুটি ২৫ কিমি দূরে রুমতি নদীর তীরে গড়ে উঠেছে এই ট্রেকার দের স্বর্গরাজ্য। পাহাড়, জঙ্গল আর গিরিখাত নিয়ে ইয়েলবং এক লুকানো খনি। রুমতি নদীর তীরে গড়ে ওঠা কেভটি লম্বায় প্রায় ২ কিমি। আর এক কোমর জলে লম্বা এই নদী পথটি কোথায়ও কোথাও মাত্র এক ফুট চওড়াতে এসে ঠেকেছে। রঙ বেরঙের প্রজাপতি, আর চেনা-অচেনা অজস্র পাখির মুক্ত রাজ্য এই ইয়েলবং।
ইয়েলবং থেকে কাছে পিঠে ঘুরে নিতে পারেন পাবং, নিমবন, চুইখিম, মানাবাড়ি, তুরিবাড়ি আর পাথরঝোড়া স্পট গুলোও। সবগুলোই আপন সৌন্দর্যে ভরপুর।

চুইখিম

কালিম্পং শহরের আর এক লুকানো ছবির মতন সুন্দর গ্রাম। চালসা থেকে দূরত্ব প্রায় ৪০ কিমি। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ১১০০ মিটার। পাহাড়, জঙ্গল আর ছোটো বড় নানা নদী নিয়ে চুইখিম গড়ে উঠেছে। এখানকার প্রধান আকর্ষণ “ইন্দ্রধনুস চুইখিম আর্থ ফেস্টিভ্যাল”।
ছবির মতন ছোট গ্রামটি অসংখ্য নাম না জানা নদী আর ঝোড়াতে সমৃদ্ধ। লিশ নদী গ্রামটিকে দুভাগে বিভক্ত করেছে। জঙ্গল, পাহাড় ছাড়াও আর আকর্ষণ বিভিন্ন পাহাড়ি রঙ বেরঙের অর্কিড । আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে যখন সারা বাংলার যে সব গ্রামে থাকার জন্য ‘হোম স্টে’ এই ধারণা তৈরি হয়েছে, চুইখিম ও তার মধ্যে ছিল। প্রচণ্ড অতিথি বৎসল মানুষ জন। এখান থেকে ২৪ কিমি গেলে পড়বে আর পাহাড়ি জনপদ সামথার।

লুংসেল-

ঝান্ডি থেকে ৫ কিমি দূরে আর এক নতুন গন্তব্য লুংসেল। ছোট অবকাশ যাপনের মনোরম স্হান। আছে একটি ভিউ পয়েন্ট আর গোটা কয়েক হোম স্টে। মাল বাজার বা চালসা থেকে গোরুবাথান আর ঝান্ডি হয়েই চলে আসতে পারেন লুংসেল। এছাড়া বাগরাকোট থেকেও যাওয়া যায়। আছে গীতখোলা নদী। ট্টেক করে জঙ্গল পথে যেতে পারেন থ্রি সিস্টার ফলস। অসাধারণ ভিউ। তবে পথ বড়ই দুর্গম। উচ্চতা অনুযায়ী লুংসেল দুটো পার্টে বিভক্ত। আপার আর লোয়ার। তবে সবই ছবির মতন সুন্দর। পায়ে হেঁটে ঘুরে নিতে পারেন নাম ফরেস্ট। এখানে তিনটে ভিউ পয়েন্ট আছে। উপর থেকে নিচে পরপর- পাইনদারা ভিউ পয়েন্ট, নেপালাদারা ভিউ পয়েন্ট আর সুকলিং ভিউ পয়েন্ট।

ঝান্ডি

চালসা ও নিউমাল জংশন থেকে একই ৩৭ কিমি দূরত্বে আর এক পাহাড়ি শহর ঝান্ডি। শহর না বলে গ্রামই বলা ভালো। ভারতবর্ষের খুব কমই শৈল শহর আছে, যাতে অতি কম সময়ে একদম টপে পৌঁছানো যায়। ঝান্ডি তার অন্যতম। উচ্চতা প্রায় ২১০০ মিটার এর কাছে। পরিবেশ জনিত কারনে তীব্র শীতের আধিক্য। আকাশ পরিস্কার থাকলে খণ্ডিত কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দর্শনের সৌভাগ্য হয়। তবে ঝান্ডিতেও মেঘের আধিক্য বড়ই। এক প্রান্তে কাঞ্চনজঙ্ঘা তো আর এক পাশে চেল নদীর উপত্যকা জুড়ে বিস্তৃত ডুয়ার্সে বিস্তীর্ণ চা বাগান আর জঙ্গল

প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নাম না জানা নানা অর্কিড বাগান। এছাড়া আছে একটি বড় স্কোয়াশ বাগান। পাহাড়ি পথে কিছুটা ট্রেক ৭ কিমি গেলেই সামালবিয়ং টি গার্ডেন। আছে টি ফ্যাক্টরিও। ঝান্ডি ছোট অবকাশ যাপনের এক আদর্শ স্পট। চারদিকে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণী, মেঘেরা উড়ে বেড়ায় আকাশ জুড়ে। নির্জন পথে ট্টেক করতে পারেন বহুদূর অবধি। গাছ পালার ফাঁকে হরিনের পাল দেখতে পাওয়া খুব আশ্চর্যের নয়। ন্যাওড়াভ্যালী অভয়ারণ্যের কাছে বলে ভালুক বা লেপার্ডের দেখতে পাওয়াও আশ্চর্যের নয়। ঝান্ডি থেকে মাত্র ৯ কিমি দূরেই রয়েছে লাভা। তাই পর্যটকরা লাভা থেকেও ঘুরে নিতে পারে ঝান্ডি বা ঝান্তিদারা। শুধু প্রাকৃতিক শোভাই নয়। ঝান্ডি তে রয়েছে চেনা-অচেনা অনেক পাখিও।
ঝান্তির ৫ কিমি আগে রয়েছে আর এক শৈল শহর লামাগাঁও। ঝান্তির মতন থাকার জন্য হোম স্টের প্রাচুর্য অবশ্য নেই। এখানে একটা ভিউ পয়েন্ট ও আছে।

যারা চালসা থেকে কনডাক্টেড ট্যুরে হিল ডুয়ার্সে ঘুরতে আগ্রহী নন, মানে শুধু লাভা দেখে ফিরতে চান না। তাদের ২ রাত পাহাড়ের যে কোনো স্পটে থেকে হিল ডুয়ার্স ঘুরে নেওয়া ভালো।
লাভা-রিশপ–লোলেগাঁও – কোলাখাম-ছাঙ্গে।

রিশপ

লাভা থেকে ৯.৫ কিমি দূরে মেঘে ঢাকা আর এক শান্ত শহর রিশপ। “রিশপ” শব্দের অর্থ পাহাড়ের মাথায় একলা গাছ। নামের সঙ্গে বাস্তবের মিল থাকুক বা না থাকুক রিশপ কিন্তু বাঙালীর মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। সারাদিনই এখানে মেঘ- রোদের খেলা চলে। তবে আকাশ পরিস্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও মাউন্ট পান্ডিম, কাব্রু, সিনিয়ালচু ও আরও নানান শৃঙ্গ দেখা যায়। দেখা যায় নাথুলা গিরিপথ ও। এমনকি চেলেলাপাস ও জোজিলাপাস ও। রিশপের উচ্চতা প্রায় ২৭০০ মিটারের কাছাকাছি। অধিক উচ্চতার জমা রিশপে ফি বছর শীতে বরফ পড়ে। রিশপের অন্যতম আকর্ষণ জঙ্গল পথে ১.৫ -২ কিমি ট্টেক করলে পড়বে রিশপের সর্বোচ্চ স্হান টিফিনদারা ভিউ পয়েন্ট। এটি উচ্চতায় সান্দাকফুর পরেই দ্বিতীয় স্হানে। এখান থেকে প্যানরমিক ভিউ পাওয়া যায়। রিশপে ইলেক্ট্রিসিটির একটু সমস্যা আছে। প্রধানত লো ভোল্টেজ এরিয়া। হোটেলের থেকে হোম স্টের সংখ্যাই বেশি। জলের ক্রাইসিস ও তীব্র। তবে সব কিছু ভুলে রিশপ আপন সৌন্দর্যে বলিয়ান। মেঘ না থাকলে এখান থেকেই সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত ভালো দেখা যায়। রিশপ জনপ্রিয়তা পেলেও আজও এর রাস্তা কাঁচা, বোল্ডার বিছানো।

কোলাখাম

পাহাড়ের আর এক রাণী কোলাখাম। লাভা থেকে ৮.৫ কিমি দূরে ন্যাওড়াভ্যালী অভয়ারণ্যের কোলে গড়ে উঠেছে এই জনপদটি। উচ্চতা বিচারে কোলাখাম লাভা ও রিশপের থেকে অনেকটা নিচুতে। তাই শীতের আধিক্য কিছু কম। তবে সৌন্দর্যে যে কোনো পাহাড়ি শহর বা গ্রামকে টেক্কা দেবে। কোলাখামের উচ্চতা ১৯৮১ মিটার। আপার ও লোয়ার দুটি ভাগে কোলাখাম বিভক্ত। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পাই, ফার, দেবদারু গাছের কোলে লাল, নীল বিভিন্ন রঙের ডিজাইনার হোমস্টে আর বাড়ি। একপাশে খণ্ডিত কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ, পাহাড়ি মনরোম আঁকাবাঁকা পথ, সব মিলে কোলাখাম অসাধারণ।
কোলাখামের প্রধান আকর্ষণ ছাঙ্গে ফলস হলেও অন্যতম আকর্ষণ এখানকার বার্ড ওয়াচিং সেন্টার। কোনো একটা বিশেষ পয়েন্ট নয়, পাখি দেখা যায় কোলাখামের প্রতিটি জঙ্গল সংলগ্ন অঞ্চল থেকে। নানা শ্রেনীর রঙ-বেরঙের পাখি দেখা যায় এখানে। ইচ্ছে হলে ঢুকতে পারেন জঙ্গলের ভিতরেও। খেলার মাঠও আছে ভিতরে। তবে প্রতি পদে সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। রেড পান্ডা ছাড়াও আছে হিমালয়ান ভালুক। এমনকি রয়েল বেঙ্গল টাইগারও।
লোয়ার কোলাখাম থেকে গভীর জঙ্গলের পথ ট্রেক করে যেতে হবে ছাঙ্গে ফলস। প্রায় ৩০০ ফুট নিচে ঝাপিয়ে পড়ছে চেল নদী। তৈরি হয়েছে লেক। লেকের পাড়ে ঝর্ণার দৃশ্য অতি মনোহর।

লোলেগাঁও

লাভা থেকে ২৪ কিমি দূরে আর এক জনপ্রিয় পর্যটন স্হল লোলেগাঁও। উচ্চতা ১৬৭৫ মিটার। উচ্চতাজনিত কারনে শীতে রিশপের মতন ঠাণ্ডার আধিক্য নেই লোলেগাঁও তে। তবে মেঘ আর কুয়াশার লুকোচুরি চলে দিন ভোর।
“লোলেগাঁও” শব্দের অর্থ সুখি গাঁও। মূলত বৌদ্ধ পার্ক, ক্যানোপি ওয়ে এসব নিয়েই লোলেগাঁও। একটি বৌদ্ধ গুম্বা আছে পার্কের সামনে। তবে পার্কটি খুব সুন্দর। যারা প্রাতভ্রমণে বের হন, তাদের কাছে এই পার্ক সীমাহীন আনন্দ দেবে। বড় বড় গাছ, টালি বিছানো রাস্তা। এখানে সেখানে বসে গল্প করার জায়গা। সব মিলে পার্কটি অসাধারণ।
প্রায় হেঁটে পার্কের বাম দিকে কিলোমিটার খানেক গেলে পড়বে বিশালবড় এরিয়া নিয়ে তৈরি ক্যানোপি ওয়াক বা ওয়ে। পাইন গাছের গভীর জঙ্গলে মাটি থেকে অনেক উচ্চতায় গড়ে ওঠা এই দড়ির রাস্তা গুলো বিনোদনের জন্য বিখ্যাত।
এছাড়া আছে প্রায় ৩-৪ কিমি দূরে ভিউ পয়েন্ট। আসলে এটি সানসেট পয়েন্ট। সবচেয়ে উ্চু জায়গা। এখান থেকে ৩৬০ডিগ্রি প্যানারোমিক ভিউ পাওয়া যায়। তবে এখানে চড়তে প্রচুর সিঁড়ি ভাঙতে হয়। রাস্তাটি বড়ই নির্জন, প্রায় জনমানস হীন। ফেরার পথে বামদিকে পড়বে ১ কিমি দূরের কাফের গাঁও এর রঙ-বেরঙ এর কটেজগুলো ছবি। মাঝে গোর্খা আন্দোলনে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পরেও এখনও লোলেগাঁও এর সৌন্দর্য অটুট আছে। তবে লোলেগাঁও এর রাস্তা ভয়াবহ। ২৪ কিমি যেতেও ১ঘণ্টা লেগে যায়।
👉👉👉মেনগ্লাস টি গার্ডেন-মাল ফরেস্ট -গোরুবাথান -চেলখোলা-ফাগু-ডালিম-পাপরখেতি-লাভা

মেনগ্লাস চা বাগান

গোরুবাথান ব্লকের অন্যতম আকর্ষণীয় চা বাগান। মূলত গোরুবাথান হয়ে রিশি রোড দিয়ে ক্রমশঃ পাহাড়ি পথের পাকদণ্ডী তে হারিয়ে যাবার আগে যে দীগন্ত বিস্তৃত ঢেউ খেলানো চা বাগান আপনাকে স্বাগত জানাবে, তা হল মেনগ্লাস বা মিনগ্লাস চা বাগান। চালসা থেকে দূরত্ব প্রায় ১৫ কিমি। চেল আর লিশ নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা এই চা বাগানে আপনার দৃষ্টি হারিয়ে যেতে পারে। মিনগ্লাস ছাড়াও আশেপাশে আছে জুরান্তি, পাথরঝোড়া ইত্যাদি বড় চাগানও।

মাল ফরেস্ট

পর্যটক আকর্ষণ উল্লেখযোগ্য না হলেও গোরুবাথান গামী যাত্রী দের কাছে অন্যতম আকর্ষণ মাল ফরেস্ট। মিনগ্লাস টি গার্ডেম ক্রশ করলেই জঙ্গল শুরু। মূলত সাকাম ফরেস্টের একটা অংশ। মাল নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে। তবে চাপরামারি, গোরুমারার জঙ্গলের মতন গগন চুম্বি মোটা মোটা গুড়ির গাছ পালার অভাব। তবে রৌদ্রজ্বল দিনে লাভা গামী বা লাভা থেকে মাল বাজার গামী যাত্রীদের কাছে ক্ষনিকের টাটকা বাতাশ এনে দেয় এই ফরেস্ট।

গোরুবাথান

চালসা থেকে মাত্র ১৯ কিমি দূরেই গোরুবাথান। প্রাচীন কালে এখানে একটা বড় গোচারণ ক্ষেত্র ছিল। ‘বাথান’ শব্দের অর্থ ‘পাল’, সেই থেকে এরকম নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়। মূলত নিউমাল জংশন থেকে সর্টরুটে লাভা যাবার পথে এই ছোট শহরটি পড়ে। বহুবছর আগে থেকেই পর্যটকদের কাছে গোরুবাথান পরিচিত হলেও এর যে নিজস্ব একটা পর্যটন সার্কিট রয়েছে, তা অনেকের কাছেই অজানা। আপার ফাগু, লোয়ার ফাগু, ডালিম, চেল খোলা, মাল ফরেস্ট, মেনগ্লাস চা বাগানের এক বিস্তৃত অংশ নিয়ে গোরুবাথান ব্লকটি গঠিত। কী না নেই এখানে। চা বাগান, পাহাড়, নদী সব নিয়ে গোরুবাথান স্বয়ংসম্পূর্ণ।
চালসা থেকে মেনগ্লাস চা বাগান ক্রশ করে শুরু হয় মাল ফরেস্ট। মূলত সাকাম ফরেস্টের দক্ষিণ অংশ। কেউ কেউ বলে ভুট্টা বাড়ি ফরেস্ট। জঙ্গলের সীমাহীন সৌন্দর্য শেষ হতে না হতেই চোখে পড়বে একের পর এক পাহাড়ি শৈলীতে নির্মিত বাড়ি। সুশোভিত বাগানে শোভা পাচ্ছে নানা রঙের অর্কিড। ডান দিকে রাস্তা আলে গেছে লোয়ার ফাগু। এটা মুলত চা বাগান। একটু এগোলেই বাঁয়ে পড়বে চেল খোলা নদী। এই নদীর অপর প্রান্তে আপার ফাগু।
মাঝে ব্রিজ। যা থেকে দু ধারের পাহাড়ের উপত্যকার ছবি অসাধারণ লাগে। গোরুবাথান আজ বড় প্রশাসনিক কেন্দ্র ও বটে। আছে প্রচুর স্কুল, আর্মি ক্যাম্প, কোর্ট ইত্যাদি। একটু হাঁটলে দেখে আসতে পারেন ‘আই লাভ ইউ গোরুবাথান ” পার্ক। তবে বহুদিন পর্যটন সার্কিটে পরিচিত হলেও গোরুবাথান যেন আজও কিছু টা ব্রাত্য পর্যটন স্হল হিসেবে। যদিও বর্তামানে প্রচুর হোম স্টে হয়েছে।

ফাগু

চালসা থেকে দূরত্ব ২১.৬ কিমি আর গোরুবাথান থেকে ৩.৫ কিমি। ফাগু এক কথায় এক অসাধারণ জায়গা। অনুচ্চ পাহাড়, চা বাগান আর এঁকে বেঁকে চেল খোলা নদী এই নিয়ে ফাগু। উচ্চতা অনুযায়ী গোরুবাথান এর উত্তর -পশ্চিম দিকে আপার ফাগু। আর দক্ষিণ -পূর্ব দিকে লোয়ার ফাগু। লোয়ার ফাগু মূলত সাকাম ফরেস্ট সংলগ্ন চা বাগান নিয়ে সেজেছে। বুড়ি খোলা, ডালিম খোলা নদী অববাহিকার গড়ে উঠেছে লোয়ার ফাগু। আর আপার ফাগু চেল খোলা কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। প্রধান আকর্ষণ একটি বৌদ্ধ গুম্বা। নাম “দীপঙ্কর স্তুপা”। চেল খোলার তীরে পড়ন্ত বিকেলে ফাগু সত্যি রঙের ফাগ ছড়িয়ে দেয়। ফাগুতে সেভাবে থাকার জায়গা গড়ে না উঠলেও চেল নদীর পারে অ্যাডভেঞ্চার টেন্ট আছে। ফাগু থেকেই চলে যেতে পারেন লামাগাঁও আর ঝান্ডি নামক দুটে জনপ্রিয় হিল ও। চেল নদীর তীরে গড়ে উঠেছে পিকনিক স্পট ও।

ডালিম

চালসা থেকে ২৯ কিমি আর গোরুবাথান থেকে ১০ কিমি দূরে রয়েছে পাহাড় আর চা বাগান ঘেরা আর এক মনোরম স্হান ডালিম। দুদিকে পাহাড় জুড়ে চা বাগান আর মাঝে মাথার সিঁথির মতন বয়ে চলা চেল আর ডালিম খোলা আর কালো পিচ ঢালা রাস্তা আপনাকে মিরিক কিংবা দক্ষিণ ভারতের মুন্নারের কথা মনে করাবে। এক অনন্য সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র এই ডালিম। এর ভিউ পয়েন্ট থেকে চেল উপত্যকার দৃশ্য অতি সুন্দর। ডালিমের অন্যতম আকর্ষণ ‘ডালিম ফোর্ট’।
অতীতে লেপচা রাজা গায়েবো আচায়কের আমলে তৈরি এই ফোর্ট এখন ধ্বংসাবশেষে পরিনত হয়েছে।
বেশ কিছুটা ট্রেক করতে হয় এই হেরিটেজ স্হানে যেতে।

পাপরখেতি

চালসা থেকে প্রায় ৩০ কিমি দূরে এই রুটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা হল পাপারখেতি। গোরুবাথান থেকে দূরত্ব প্রায় ১২ কিমি। পাহাড় পরিয়ে এসে চেল নদী লাফিয়ে পড়ছে বহু নিচের উপত্যকায়। ধোঁয়া হয়ে বাষ্পীভূত হচ্ছে জল। প্রচণ্ড স্রোতের টান। ছোটো বড় নানা বোল্ডার গড়িয়ে যাচ্ছে স্রোতের সাথে। এক কথায় পাপরখেতি এক অনবদ্য পর্যটন কেন্দ্র। ব্রিজের উভয় পাশের সৌন্দর্যই অসাধারণ। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে পারেন নিচের নদী তটে। ঠাণ্ডায় জলে পা ভিজিয়ে একটু রোমান্টিক ও হতে পারেন। পাশে একটি ছোটো মন্দির ও আছে। আছে ছোট কিছু দোকান। ক্ষনিকের বিরতিতে নিতে পারেন মোমোর স্বাদও।

লাভা-

চালসা থেকে ৫৮ কিমি দূরেই রয়েছে লাভা শৈল শহর। আজ থেকে ২৫ বছর আগেও লাভা- লোলেগাঁও বলতে লোকে বুঝত দুই অখ্যাত গ্রাম কে। আস্তে আস্তে ক্রমশঃ ঘিঞ্জি হয়ে যাওয়া দার্জিলিং এর বিকল্প হিসাবে গড়ে ওঠে লাভা। পাইনের বাহারি জঙ্গল আর নিরিবিলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই ছিল লাভার প্রধান আকর্ষণ। বয়সে দার্জিলিং এর থেকে অনেক ছোট হলেও উচ্চতায় অনেকটাই উপরে হল লাভা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ২২০০ মিটার। প্রধান আকর্ষণ কাগ্যু তেকচেন লিং মনাস্টেরি। যাকে সবাই লাভা মনাস্টেরি বলে জানে। বিশালাকৃতির এই মনাস্টেরির পিছনের শোভা অনবদ্য। যদিও করোনার পর থেকে সাধারনের জন্য দ্বার রুদ্ধ মন্দিরের।
মনাস্টেরি ছাড়াও রয়েছে একটা ইন্টার প্রিটিশান সেন্টার। স্হানীয়রা বলে মিউজিয়াম। আসলে ন্যাওড়াভ্যালী অভয়ারণ্যের বিভিন্ন প্রানীর অস্তিত্বের নিদর্শন রয়েছে মিউজিয়ামে। আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব ও।
এছাড়া আছে একটা টি ফ্যাক্টরি। লাভা বাসস্টপ থেকে একটু নামলে চোখে পড়ে লাভা বাজার। ঘন ঘন দোকান পাঠ আর হোটেলে ঘিঞ্জি করে ফেলেছে লাভার সৌন্দর্য কে। কাঞ্চনজঙ্ঘা আজও দৃশ্যমান বিভিন্ন হোটেল থেকে। লাভা থেকেই ঘুরে নিতে পারেন ৯.৫ কিমি দূরত্বেের রিশপ আর ৮.৫ কিমি দূরের কোলাখাম।
প্যারেন, দলগাঁও ভিউ পয়েন্ট, গৈরিবাস, রঙ্গো, গোদক, চিসাং, তোদে, তাংতা।

প্যারেন

চালসা থেকে প্রায় ৪২ কিমি দূরে আর জলঢাকা থেকে ১০ কিমি দূরত্বে ছবির মতন পাহাড়ি স্হানটির নাম প্যারেন। পাহাড়, জঙ্গলের সমাহার নিয়ে প্যারেন এক অপূর্ব ছবির মতন সৌন্দর্য নিয়ে পর্যটন মানচিত্রে স্হান করে নিয়েছে। আর রয়েছে কমলালেবু আর অ্যালাচের বাগান। যারা একটু নিরিবিলি স্হান পছন্দ করে তাদের জন্য প্যারেন এক আদর্শ স্হান। স্হান ভেদে প্যারেন তিনটে ভাগে বিভক্ত। আপার, লোয়ার আর নিউ। জঙ্গলের নিবিড় সৌন্দর্যের মাঝে রাত্রিযাপনের জন্য আছে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কিছু রেস্ট হাউজ। নিশ্চুপ প্রকৃতির মাঝে জঙ্গলের গাছপালার ফিসফাস শব্দ আর পাখির ডাকের মূর্ছনা আপনাকে মুক্তির স্বাদ দেবে।

দলগাঁও ভিউ পয়েন্ট

চালসা থেকে প্রায় ৩৫ কিমি দূরে আর এক ছবির মতন শহর দলগাঁও। ন্যাওড়াভ্যালি অভয়ারণ্যের দক্ষিণ প্রান্তে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮০০ মিটার উঁচুতে জঙ্গল- পাহাড় ঘেরা কালিম্পং জেলার এই স্হানটি তুলনামূলক অল্প পরিচিত হলেও সীমাহীন সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অপেক্ষা করছে। প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্যের মাঝে এখানকার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য সিঙ্কোনা চাষ। ভারতের অন্যতম সিঙ্কোনা চাষের প্ল্যান্টেশন এখানেই। যেখানে সিঙ্কোনা থেকে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কুইনাইন প্রস্তুত করা হয়। এছাড়া রয়েছে রঙ বেরঙের অসংখ্য ফুলের বাগান। অনন্য সুন্দর কাঠের সব বাড়ি। এখানকার ভিউ পয়েন্ট থেকে ভুটানের অধিকাংশ স্হান দৃশ্যমান। দৃশ্যমান জলঢাকা নদী আর বিন্দু তে জলঢাকা নদীর তীরে হাইড্রাল প্রজেক্টও। ভিউ পয়েন্টে একটা ওয়াচ-টাওয়ার আছে। ডুয়ার্সে এলে এই স্হান অবশ্যই দর্শনীয়।

গৈরিবাস

চালসা থেকে ২৯ কিমি দূরে ছোট পাহাড়ি জনপদ গৈরিবাস। অ্যালাচ আর রবার চাষের জন্য পুরো অঞ্চলটি বিখ্যাত। বিন্দু বা ঝালং যেতে গৌরিবাসের পাহাড়ি আঁকা বাঁকা পথ পেরিয়ে ঠিক যেখানে এসে প্রতিটি গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে, সেটা হল গৈরিবাস ভিউ পয়েন্ট। এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ রূপসী ঝালং কে সবচেয়ে ভালো দেখায় এখান থেকেই। বহু নীচু দিয়ে বয়ে চলা জলঢাকা, ঝোলুং খোলা আর বিন্দু খোলা নদীর সব চেয়ে ভালো ভিউ এখান থেকেই পাওয়া যায়। পাহাড়ের ধাপে ঝুম চাষের দৃশ্যও কম মনোমুগ্ধকর না।

লাভা-

চালসা থেকে ৫৮ কিমি দূরেই রয়েছে লাভা শৈল শহর। আজ থেকে ২৫ বছর আগেও লাভা- লোলেগাঁও বলতে লোকে বুঝত দুই অখ্যাত গ্রাম কে। আস্তে আস্তে ক্রমশঃ ঘিঞ্জি হয়ে যাওয়া দার্জিলিং এর বিকল্প হিসাবে গড়ে ওঠে লাভা। পাইনের বাহারি জঙ্গল আর নিরিবিলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই ছিল লাভার প্রধান আকর্ষণ। বয়সে দার্জিলিং এর থেকে অনেক ছোট হলেও উচ্চতায় অনেকটাই উপরে হল লাভা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ২২০০ মিটার। প্রধান আকর্ষণ কাগ্যু তেকচেন লিং মনাস্টেরি। যাকে সবাই লাভা মনাস্টেরি বলে জানে। বিশালাকৃতির এই মনাস্টেরির পিছনের শোভা অনবদ্য। যদিও করোনার পর থেকে সাধারনের জন্য দ্বার রুদ্ধ মন্দিরের।
মনাস্টেরি ছাড়াও রয়েছে একটা ইন্টার প্রিটিশান সেন্টার। স্হানীয়রা বলে মিউজিয়াম। আসলে ন্যাওড়াভ্যালী অভয়ারণ্যের বিভিন্ন প্রানীর অস্তিত্বের নিদর্শন রয়েছে মিউজিয়ামে। আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব ও।
এছাড়া আছে একটা টি ফ্যাক্টরি। লাভা বাসস্টপ থেকে একটু নামলে চোখে পড়ে লাভা বাজার। ঘন ঘন দোকান পাঠ আর হোটেলে ঘিঞ্জি করে ফেলেছে লাভার সৌন্দর্য কে। কাঞ্চনজঙ্ঘা আজও দৃশ্যমান বিভিন্ন হোটেল থেকে। লাভা থেকেই ঘুরে নিতে পারেন ৯.৫ কিমি দূরত্বেের রিশপ আর ৮.৫ কিমি দূরের কোলাখাম।
প্যারেন, দলগাঁও ভিউ পয়েন্ট, গৈরিবাস, রঙ্গো, গোদক, চিসাং, তোদে, তাংতা।

প্যারেন

চালসা থেকে প্রায় ৪২ কিমি দূরে আর জলঢাকা থেকে ১০ কিমি দূরত্বে ছবির মতন পাহাড়ি স্হানটির নাম প্যারেন। পাহাড়, জঙ্গলের সমাহার নিয়ে প্যারেন এক অপূর্ব ছবির মতন সৌন্দর্য নিয়ে পর্যটন মানচিত্রে স্হান করে নিয়েছে। আর রয়েছে কমলালেবু আর অ্যালাচের বাগান। যারা একটু নিরিবিলি স্হান পছন্দ করে তাদের জন্য প্যারেন এক আদর্শ স্হান। স্হান ভেদে প্যারেন তিনটে ভাগে বিভক্ত। আপার, লোয়ার আর নিউ। জঙ্গলের নিবিড় সৌন্দর্যের মাঝে রাত্রিযাপনের জন্য আছে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কিছু রেস্ট হাউজ। নিশ্চুপ প্রকৃতির মাঝে জঙ্গলের গাছপালার ফিসফাস শব্দ আর পাখির ডাকের মূর্ছনা আপনাকে মুক্তির স্বাদ দেবে।

রঙ্গো

গৈরিবাস পেরিয়ে ৭ কিমি দূরে আর ঝালং থেকে ১১ কিমি দূরে ডানদিকে ঝালং আর বিন্দু কে রেখে প্যারেন পেরিয়ে পরবর্তী গন্তব্য রঙ্গো। কালিম্পং জেলার অন্যতম অনাঘ্রাত ছবির মতন সুন্দর গ্রাম। পাহাড়, জঙ্গল আর অজস্র নদী নালা নিয়ে রঙ্গো রূপকথার অচিনপুরী হয়ে রয়ে গেছে। এখানকার উচ্চতা ৩০০ থেকে ৩০০০ মিটার। প্রধান আকর্ষণ অরগানিক সব্জি চাষ। এছাড়া বিভিন্ন ঔষধি গাছের ও চাষ হয়। প্রচুর বৃষ্টির জন্য একে পশ্চিমবঙ্গের চেরাপুঞ্জি বলে। পাহাড়, ঝোড়া, জঙ্গল সব নিয়ে রঙ্গো পর্যটনের নতুন আকর্ষণ। এখান থেকেই ঘুরে নিতে পারেন গোদক, চিসাং, তোদে, তাংতা এমন কি ঝালং, বিন্দুও। ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখে নিতে পারেন ভুটানের বরফাচ্ছাদিত ভুটানের শৃঙ্গ রাজিকে। এছাড়া জলঢাকা অববাহিকার সম্পূর্ণ দৃশ্যপটও এখান থেকে দৃশ্যমান।

গোদক

চালসা থেকে ৪২ কিমি দূরে কালিম্পং এর আর এক অনাঘ্রাত ছোটো পাহাড়ি জনপদ হল গোদক। ন্যাওড়াভ্যালি অভয়ারণ্যেের কোলে পাহাড়ের বুকে গড়ে ওঠা এই জনপদটি এতদিন ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। প্রধানত রাস্তাঘাটের ভয়ঙ্কর দশাই এই স্হানটিকে এতদিন পর্যটকদের কাছে ব্রাত্য করে রেখেছে। তবে যারা গেছে তারাই জানে প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্যে ভরপুর এই স্হান। এখন অবশ্য বেশ কিছু হোমস্টে গড়ে উঠেছে। এখান থেকেই ইচ্ছে হলে ঘুরে আসতে পারেন চিসাং, তোদে, তাংতার জনপ্রিয় স্হান গুলো। যদিও থাকার জন্য চিসাং বেশি জনপ্রিয়।

চিসাং

চালসা থেকে ৪৬ কিমি আর গোদক থেকে মাত্র ৪ কিমি দূরে কালিম্পং এর সবচেয়ে আলোচিত নতুন অনাঘ্রাত স্পটটি হল চিসাং। চিসাং কে বলা যায় “হিডেন বিউটি”। এতদিন পর্যটন মানচিত্রে কেন এই স্হান জায়গা করেনি, সেটাই রহস্য। তবে এর পিছনে রাস্তাঘাটের দূরাবস্থাই দায়ী। চিসাং এ বরফ পড়ে না। তবে এখান থেকে বরফাচ্ছাদিত শৃঙ্গরাজি দেখা যায়। যদিও অনেকে তা কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে গুলিয়ে ফেলে। আসলে ডুয়ার্স থেকে বা চিসাং থেকে যা দেখা যায়, তা হল ভারত-ভুটান-চিন সীমান্তের নিকটে থাকা ডোকালাম পাহাড়ের বরফ পড়ার দৃশ্য।
অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্ভারে পরিপূর্ণ চিসাং প্রধান আকর্ষণ যদি বরফে ঢাকা হিমালয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা হয়, তবে আর এক কারন হল বিভিন্ন রঙের অর্কিডের মেলা। থাকার জন্য এখানে কিছু হোম স্টে থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এখান থেকেই তোদে, তাংতার জনপ্রিয় স্হান গুলো কম সময়ে দেখে ফেরা যায়।

তোদে

চালসা থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরে কালিম্পং জেলার আর এক আকর্ষণীয় অনাঘ্রাত পাহাড়ি জনপদ টি হল তোদে। ‘তোদে খোলা’ নদী থেকে ‘তোদে’ নামের উৎপত্তি। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৫০০ মিটার উঁচুতে ন্যাওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের কোলে অবস্হিত এই জনপদটি এলাচ ও কমলালেবু চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল একসময়। তবে সে সব এখন অতীত। ভারত- ভুটান সীমান্তে গড়ে ওঠা এই জনপদটি কোনো এক অজানা কারনে এতদিন লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিল যা বর্তমানে প্রচারে এসেছে। এখানকার প্রধান আকর্ষণ দাবাইখোলা নদী। যে নদীর জল ঔষধি গুনে সমৃদ্ধ। তাই হাজার ব্যামো সাড়ায়। ঘন জঙ্গল, পাহাড় আর নদী বেষ্টিত এই স্হান অফুরন্ত সৌন্দর্যে ভরপুর।
ভুটান বর্ডার ঘেঁষা বলে দু দেশের লোকের অবাধ যাতায়াত। বরফ না পড়লেও শীতে তাপমাত্রা ৩-৪ ডিগ্রি তে নামে। ভারত-চিন-ভুটান সীমান্তের ডোকালামের বরফাচ্ছাদিত শৃঙ্গ গুলো এখান থেকে ভালো দেখা যায়।
এখানে থাকার জন্য বেশ কিছু হোম স্টে আছে। যদিও থাকার জায়গা কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টেন্টই ভরসা। রাস্তার অবস্থা অতি ভয়ংকর। তবুও এখানে থেকেই ঘুরে নেওয়া যায় তাংতা মনাস্টেরি।

তাংতা

কালিম্পং এর অন্যতম হিডেন বিউটি হল তাংতা। আসলে তোদে আর তাংতাকে বলা যায় যমজ শহর। ন্যাওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের কোলে অন্যতম প্রকৃতিক মনোরম স্হান এই তাংতা। ভারত-ভুটান সীমান্তের রাচেলা পাস সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। তাংতা মূলত বিখ্যাত ট্রেকারদের স্বর্গ রাজ্য হিসাবে। বিন্দু থেকে ন্যাওড়াভ্যালির জঙ্গল চিরে ৮ ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায় তাংতা। এখানকার তাংতা মনাস্টেরি খুবই বিখ্যাত। এছাড়া তাংতা নদী, চুম মেং নদী, ভুটিয়া গাঁও অন্যতম দর্শনীয় স্থান। হোম স্টে তুলনামূলক কম থাকায় নদীর পাড়ে অস্হায়ী রূপে গড়ে ওঠা অসংখ্য ক্যাম্পই পর্যটকদের প্রধান আশ্রয়স্হল আর ভ্রমণ স্হল। ছোটো ছোটো পাহাড়ি নদীর বুকে তিরতির করে বয়ে চলা স্বচ্ছ কাঁচের মতন জলের অসাধারণ সৌন্দর্য এক রাত না থাকলে বোঝা সম্ভব নয়। তবে রাস্তাঘাটের ভয়ঙ্কর অবস্থা পর্যটক দের আনাগোনা বাড়ানোর পরিপন্থী। তোদে থেকে গাড়ির রাস্তা আর নেই বললেই চলে। এখান থেকেই রাচেলা পাস হয়ে চলে যেতে পারেন কালিম্পং ও।

মোহময়ী ডুয়ার্স

ডুয়ার্স পাহাড়, জঙ্গল, চা বাগান, ঝর্ণা আর নদী নিয়ে এক বিস্তৃত অঞ্চল। কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার আর কোচবিহার জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে ডুয়ার্স গঠিত। তাই বৈচিত্র আর সৌন্দর্যের শেষ নেই। পুরো ঘুরতে গেলেও তাই ৮-৯ দিন লেগে যাওয়া স্বাভাবিক। তাই ভ্রমণ করার সময় দিন হিসেবে একে কয়েকটি পার্টে ভাগ করে ঘোরাই ভালো। আমরা সময়, দূরত্ব অনুযায়ী একে কয়েকটি পার্টে ভেঙে ঘুরতে পারি।

👉👉৭ পয়েন্টস, মানে সামসিং, সুনতালেখোলা, রকি আইল্যান্ড, লালিগুরাস, ঝালং, বিন্দু এবং মূর্তি।

সামসিং

চালসা থেকে প্রায় ১৬ কিমি দূরে মেটিলি ব্লকের প্রথম গন্তব্য স্হলটি হল সামসিং। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০০ মিটার উঁচুতে পাহাড়, জঙ্গল আর চা বাগান ঘেরা এই স্হানটি অবস্হিত। সামসিং মূলত বিখ্যাত তার চা বাগান আর টি এস্টেটের জন্য। যেদিকে তাকানো যায়, ঢেউ খেলানো চা বাগান। ইংরেজদের হাত ধরেই এখানে চা বাগানের কাজ শুরু হয়। সামসিং ভিউ পয়েন্ট থেকে মূর্তি নদী আর তার দুধারের উপত্যকার সবচেয়ে ভালো দৃশ্য দেখা যায়। এখান থেকেই মাত্র ৪ কিমি গেলে সুনতালেখোলা। সুনতালেখোলা ছাড়াও এছাড়া এখান থেকে ই ঘুরে নিতে পারেন রকি আইল্যান্ড আর লালিগুরাস নামক জনপ্রিয় স্হান দুটিও। এছাড়া আছে মন্তলগাঁও শিবমন্দির ও।

সুনতালেখোলা

বর্তমান কালিম্পং জেলার পাহাড় -জঙ্গল ঘেরা এক অতি মনোরম স্হান হল সুনতালেখোলা। নেপালি ভাষায় “সুন্তালে” শব্দের অর্থ হল কমলালেবু। আর “খোলা” শব্দের অর্থ হল নদী। চালসা থেকে মাত্র ২১.৭ কিমি দূরেই রয়েছে ডুয়ার্সের এই জনপ্রিয় স্হানটি। সমুূ্দ্র পৃষ্ঠ থেকে ৭৫০ মিটার উঁচুতে এই গ্রামটি ছবির মতন সুন্দর। সামসিং থেকে দূরত্ব প্রায় ৪ কিমি। মূর্তি নদীর উপর একটি ঝুলন্ত ব্রিজ হল এই স্হানের মূল আকর্ষণ। তবে শুধু ব্রিজ নয়, পুরো জনপদটিই অসীম সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য। সামসিং অবধি যেকোন গাড়িতে এসে এখান থেকে লোকাল সিন্ডিকেটের গাড়ি নিয়েই আপনাকে আসতে হবে সুনতালেখোলা। তবে গাড়ি নয়, আসল আকর্ষণ অপেক্ষা করছে হাঁটা পথেই। পাহাড়ি পাকদণ্ডী বেয়ে দুধারের চা বাগান, জঙ্গল আর পাহাড়ি শৈলীর বাড়িঘর পেরিয়ে মিনিট পঁচিশ- তিরিশের পথ চলা যেন কীভাবে কেটে যাবে, টের পাওয়া যায় না।
শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়। ন্যাওড়াভ্যালী ন্যাশানাল পার্কের অন্তর্ভুক্ত এই স্হানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর পাখিও দেখা যায়। সেগুলো হল পন্ড হেরন, ব্ল্যাক ইগল, হিল প্যাট্রিডজ, ব্রোন্জড ড্রঙ্গো, হোয়াইট থ্রোটেড ফ্যান্টেইল, ব্লু রক থ্রাশ, স্কারলেট মিনিভেট এবং কমন গ্রীন ম্যাগপাই। ন্যাওড়া ফরেস্ট এর অন্তর্ভুক্ত বলে চিতাবাঘ ও ভাল্লুকের দেখা পাওয়াও আশ্চর্যের না।

রকি আইল্যান্ড

এর বাংলা অর্থ পাথুরে দ্বীপ। চালসা থেকে ২০ কিমি আর সামসিং থেকে মাত্র ২ কিমি দূরে আর এক আকর্ষণীয় স্হান রকি আইল্যান্ড। চারদিকে পাহাড় ঘেরা মূর্তি নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে রকি আইল্যান্ড। এখানে মূর্তি পাহাড় থেকে ঝাপিয়ে পড়েছে। তাই স্রোতও বেশি রয়েছে। একটা কংক্রিটের ব্রিজ, আর নিচে বড় বড় পাথরের আড়ালে স্রোতস্বিনী মূর্তি। দু- তিনটে হোটেল ছাড়া এখানে থাকার জায়গা বলতে কিছু টেন্ট অ্যাকোমোডেশান। ইচ্ছে করলে মূর্তির স্বচ্ছ জলে স্নানও সেরে নিতে পারেন। এই নদীর কুলকুল শব্দ আপনাকে মুগ্ধ করবেই। এপ্রিল – মে মাসেও শীত অনুভুত হয় এখানে।

লালিগুরাস

এমনি তে সবাই জানে রডোড্রেনডন ফুলের আর এক নাম লালিগুরাস। তবে এই লালিগুরাস হল চা বাগান আর দু ধারের পাহাড়ের উপত্যকা নিয়ে সমৃদ্ধ। সামসিং থেকে মাত্র ৩ কিমি দূরেই এই ছোটো জনপদ। মূর্তি নদীর উচ্ছলতাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এই নয়নাভিরাম পিকনিক স্পট। ভিউ পয়েন্ট থেকে পাকদণ্ডী বেয়ে নামতে হয় অনেক নিচে। উপরের ভিউও অসাধারণ। একটু দূরেই কুমাই চা বাগান। চোখের দৃষ্টি যতদূর যায় শুধু সবুজ দিগন্ত। আর মেঘেরা ছুটে চলে হাতের নাগালে। সে এক মায়াবী দৃশ্য।

কুমাই

এক কথায় সবুজ ভেলভেটের দেশ। চারদিকে দিগন্ত বিস্তৃত চা বাগান নিয়ে কুমাই অবস্থিত। চালসা থেকে দূরত্ব ২২ কিমি। দুদিক দিয়ে যাওয়া যায়। সামসিং যাবার পথেও যাওয়া যায়। আবার চাপরামারি ফরেস্ট ছুঁয়ে ও যাওয়া যায়। কুমাই আপার ও লোয়ার দুটো ভাগে বিভক্ত।
কুমাই ভিউ পয়েন্ট থেকে ভুটান পাহাড়ের সৌন্দর্য অসাধারণ লাগে। ৭ পয়েন্টস ঘোরার সময় সাধারণত দুদিক থেকেই যাওয়া যায়। আপনি সামসিং, সুনতালেখোলা হয়েও ঝালং, বিন্দু যেতে পারেন আবার ঝালং, বিন্দু হয়েও যেতে পারেন সামসিং, সুনতালেখোলা। তবে যেখানেই যান মাঝখানে কুমাই হয়েই যেতে হবে। একটা ছবির মতন গ্রাম। দু’ধারে চা বাগান আর বাড়িঘর। মাঝে কালো পিচের রাস্তা। এক কথায় অনবদ্য।

ঝালং

কুমাই পেরিয়ে পরের গন্তব্যটি হল ঝালং। জলঢাকা নদীর তীরে ভুটান বর্ডার সংলগ্ন এই ছবির মতন পর্যটন স্হলটি চালসা থেকে ৩১.৫ কিমি দূরে অবস্হিত। যারা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়, তাদের কাছে ঝালং এক কথায় স্বর্গ। আপনি যদি মূর্তি নদীকে আগে দেখে ঝালং এর দিকে যাত্রা শুরু করেন, তবে মূর্তি ব্রিজ ক্রশ করে খুনিরা মোর হয়ে বাম দিকে চাপরামারি জঙ্গল ও রেল স্টেশন পেরিয়ে সোজা গেলেই পড়বে এই নৈসর্গিক স্হান। আপনি সামসিং হয়ে কুমাই হয়েও আসতে পারেন।
চাপরামারি জঙ্গলের প্রাচীন শাল, সেগুনের বিশালাকার গাছের জঙ্গল পেরিয়ে শুরু হবে সিপচু চা বাগানের সীমাহীন সৌন্দর্য। তারপরও অ্যালাচের ক্ষেত পেরিয়ে অ্যালাচের ঘ্রান নিতে নিতে যেতে হবে আরও বেশ কিছু টা পথ। জলঢাকা নদীকে দেখতে পাবেন অনেক উঁচু ভিউ পয়েন্ট থেকে। ধীরে ধীরে গাড়ি যত নামবে, তত প্রস্ফুটিত হবে ঝালং এর সৌন্দর্য। অসংখ্য ছোটো, বড় কটেজ আর হোটেল, চাষের ক্ষেত, সব কিছু নিয়ে রূপসী ঝালং অপেক্ষা করবে আপনাদের জন্য। জলঢাকা ছাড়াও আছে ঝালং খোলা নদী। ধাপে ধাপে ঝুম চাষ, নদী, পাহাড় সব মিলিয়ে এক অসাধারণ নৈসর্গিক স্হান এই ঝালং।

বিন্দু

চালসা থেকে দূরত্ব প্রায় ৪০ কিমি আর ঝালং থেকে দূরত্ব ১২ কিমি।
বিন্দু হল ভারতের শেষ গ্রাম। তারপরই ভুটান বর্ডার। ‘বিন্দু’ কথাটা আক্ষরিক অর্থে খুব ছোটো হলেও সৌন্দর্যের নিরিখে এর ব্যপ্তি বিশাল।
চারদিকে পাহাড় পরিবেষ্টিত বিন্দুর আসল সৌন্দর্য হল তার বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া জলঢাকা নদী। বড় বড় পাথরের বুক চিড়ে বয়ে চলা গাঢ় নীল স্রোতস্বিনী জলঢাকার কুলকুল শব্দ আপনাকে স্থবির করে দেবেই। মন্ত্র মুগ্ধের মতন বসে থাকতে হবে পাথরের বুকে ঝাপিয়ে পড়া বিভাজিত জলরাশীর শিতল স্পর্শ অনুভব করতে। একটু পিছনেই জলঢাকা হাইড্রাল প্রজেক্ট। ওপারে বিন্দু ড্যাম। ইচ্ছে করলে ঢুকতে পারেন ভুটানের ভিতরেও। তবে রেস্ট্রিকসান প্রচণ্ড। পুরোটা আর্মি এড়িয়া। ইচ্ছে করলে শীতল দুপুরে পরখ করতে পারেন রাস্তার পাশের দোকানগুলো থেকে মোমোও।